বৃষ্টির শহর, প্রথম প্রেম

বৃষ্টির শহর, প্রথম প্রেম

শহরের আকাশে সেদিন ছিল মেঘেদের আনাগোনা। কালো মেঘেদের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে ছিল এক নতুন গল্পের ইশারা। শ্রাবণের অঝোর ধারায় যখন শহর ভাসছিল, তখন নিলাঞ্জনা ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিল। ওর ভেতরের অস্থিরতা যেন বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটার সাথে মিশে যাচ্ছিল। আজই ওর আর্ট কলেজের প্রথম দিন। নতুন শহর, নতুন মানুষ আর তার বুকের গভীরে আঁকা স্বপ্নগুলো – সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করছিল সে।

নীচে, রাস্তার মোড়ে একটা পুরনো সাইকেলের দোকানে আশ্রয় নিয়েছিল এক ছেলে। সাইকেলের টায়ার সারাতে সারাতে সে বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিল। ওর নাম অনুভব, শহরে নতুন এসেছে। ওরও আজ নতুন কলেজে প্রথম দিন। কিন্তু এই অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি ওকে আটকে রেখেছে।

বৃষ্টি একটু কমতেই অনুভব সাইকেল নিয়ে ছুটল কলেজের দিকে। পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় আধ ঘন্টা দেরি হয়ে গেল। ক্লাসের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই ওর চোখ আটকে গেল শেষ বেঞ্চের মেয়েটার দিকে। হালকা নীল শাড়ি, খোলা চুল আর গভীর চোখ – যেন এক জলরঙের ছবি। সে আর কেউ নয়, নিলাঞ্জনা।

প্রথম দেখাতেই অনুভব যেন এক অজানার টানে নিলাঞ্জনার দিকে ঝুঁকেছিল। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ওর চোখ নিলাঞ্জনার উপরই থাকত। নিলাঞ্জনাও অনুভব করত একজোড়া চোখ যেন ওকে অনুসরণ করছে। হয়তো মনের অজান্তেই তাদের দুজনের মনে এক নীরব মুগ্ধতার জন্ম নিচ্ছিল।

কয়েক দিন পর, কলেজের বার্ষিক আর্ট ফেস্টিভ্যাল শুরু হলো। নিলাঞ্জনা তার তুলির জাদুতে ফুটিয়ে তুলছিল এক অদ্ভুত মন খারাপ করা শহরের দৃশ্য। অনুভব মুগ্ধ হয়ে দেখছিল ওর কাজ। একসময় সাহস করে সে নিলাঞ্জনার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

"আপনার ছবিগুলো খুব সুন্দর," অনুভবের গলা যেন একটু কেঁপে উঠল।

নিলাঞ্জনা হালকা হাসল। "ধন্যবাদ।"

সেই শুরু। এরপর তাদের কথা শুরু হলো ছবির রঙ, তুলির টান আর স্বপ্নের আকাশ নিয়ে। তারা জানত না, কখন তাদের বন্ধুত্ব ভালোবাসায় রূপান্তরিত হচ্ছিল। বিকেলে কলেজের মাঠে বসে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করত। নিলাঞ্জনা ওর ছোটবেলার স্বপ্নগুলোর কথা বলত, আর অনুভব শোনাত তার অজানা শহরের গল্প। বৃষ্টির দিনে তারা একসাথে কফি খেত, আর এক ছাতার তলায় হাঁটত শহরের অলিগলি। তাদের প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক একটা নতুন গল্পের জন্ম দিত।

একদিন, কলেজের শেষ প্রান্তে এক পুরনো কফি শপে বসে ছিল তারা। বাইরে তখনো হালকা বৃষ্টি ঝরছে। কফির ধোঁয়ার মধ্যে অনুভব নিলাঞ্জনার হাতটা ধরল। নিলাঞ্জনা চমকে উঠল, কিন্তু হাতটা সরিয়ে নিল না।

অনুভব ওর চোখে চোখ রেখে বলল, "আমার জীবনে তুমি আসার পর সব রং যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আমি... আমি তোমাকে ভালোবাসি, নিলাঞ্জনা।"

নিলাঞ্জনার চোখ ভিজে উঠল। ওর বুকের ভেতরের ভালোবাসার নদী যেন বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। সে অনুভবের দিকে তাকিয়ে শুধু হাসল, আর সেই হাসিতেই ছিল ভালোবাসার সমস্ত স্বীকারোক্তি।

আজও যখন শহরের আকাশে মেঘ জমে, আর বৃষ্টি নামে, নিলাঞ্জনা আর অনুভব সেই পুরনো কফি শপে বসে। তাদের হাতে গরম কফি, আর চোখে ভালোবাসার গভীরতা। বৃষ্টি শুধু তাদের কাছে জল নয়, এ হলো ভালোবাসার প্রতীক – সেই বৃষ্টির শহরের, যেখানে তাদের প্রথম প্রেম শুরু হয়েছিল। প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটা তাদের মনে করিয়ে দেয় সেই প্রথম দেখা, প্রথম কথা আর সেই অফুরন্ত ভালোবাসার গল্প।

গল্পটি আপনার কেমন লেগেছে? 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.