সুলতানা বেগমের চরিত্র: ত্যাগের প্রতিচ্ছবি
সুলতানা বেগম, নামেই যার শান্ত ও স্নিগ্ধ এক প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে, বাস্তবিকই তিনি ছিলেন একজন ধীরস্থির, কর্তব্যপরায়ণ এবং ভীষণ ধৈর্যশীল নারী। তার বয়স পঁয়তাল্লিশ পেরোলেও, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত তাকে কাবু করতে পারেনি; বরং প্রতিটি অভিজ্ঞতাই তাকে আরও দৃঢ় করে তুলেছিল। গ্রামের এক সাধারণ পরিবারে তার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই তিনি জেনে এসেছেন, জীবন মানেই সংগ্রাম, আর ভালোবাসার আসল অর্থ হলো ত্যাগ। বিয়ের পর স্বামী আর একমাত্র সন্তান রায়হানকে নিয়েই ছিল তার ছোট্ট পৃথিবী। স্বামীর সীমিত আয় দিয়ে কোনোমতে সংসার চলত, তাই বিলাসিতা ছিল তাদের কাছে এক অলীক স্বপ্ন।
সুলতানা বেগমের চরিত্রটি ছিল অকৃত্রিম সরলতায় মোড়া। লোকদেখানো বা বাহুল্য তার স্বভাবে ছিল না। ভোরে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত সংসারের কাজকর্মে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। তার দিন শুরু হতো ফজরের নামাজ দিয়ে, আর শেষ হতো ছেলের মঙ্গল কামনায়। নিজের জন্য তার কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না বললেই চলে। মলিন শাড়ি আর সাদামাটা জীবনযাপনেই তিনি খুঁজে পেতেন আত্মতৃপ্তি। প্রতিবেশীরা তাকে শ্রদ্ধা করত তার পরিশ্রমী স্বভাব, বিনয় এবং শান্ত আচরণের জন্য। তিনি সবার বিপদে এগিয়ে যেতেন, সাধ্যমতো সাহায্য করতেন। কিন্তু তার ভেতরের শক্তি ও দৃঢ়তা ছিল পর্বতসম। যখনই কোনো প্রতিকূলতা আসত, তিনি নীরবে তা মোকাবেলা করতেন, মুখ ফুটে কোনো অভিযোগ করতেন না। তার কাছে জীবন ছিল একটি দায়িত্ব, যা তিনি পরম নিষ্ঠার সাথে পালন করে গেছেন।
রায়হানের প্রতি সুলতানা বেগমের অগাধ ভালোবাসা: এক অটুট বন্ধন
রায়হান ছিল সুলতানা বেগমের জীবনের একমাত্র অবলম্বন, তার বেঁচে থাকার কারণ। মা হিসেবে সন্তানের প্রতি ভালোবাসা স্বাভাবিক হলেও, সুলতানা বেগমের ভালোবাসা ছিল এক অন্য মাত্রার। এটি কেবল মমতা বা স্নেহ ছিল না, ছিল এক গভীর ভক্তি, এক নিদারুণ আত্মিক টান। রায়হান যখন ছোট ছিল, তখন থেকেই সুলতানা বেগম নিজের সব স্বপ্ন ভুলে গিয়েছিলেন। তার একমাত্র স্বপ্ন ছিল রায়হানকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। দিনের পর দিন তিনি নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে গেছেন শুধু রায়হানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে।
রায়হানের প্রতিটি ছোট-বড় সাফল্য ছিল সুলতানা বেগমের কাছে জীবনের সেরা উপহার। যখন রায়হান প্রথম হাঁটতে শিখল, যখন সে প্রথম স্কুলে গেল, যখন পরীক্ষায় ভালো ফল করল – প্রতিটি মুহূর্তই ছিল তার কাছে উৎসবের মতো। তিনি গভীর মগ্নতায় রায়হানের পড়াশোনার তদারকি করতেন। বিদ্যুৎ না থাকলে হারিকেনের আলোয় নিজে জেগে থাকতেন, যাতে রায়হান নির্বিঘ্নে পড়তে পারে। নিজের না খেয়েও তিনি নিশ্চিত করতেন রায়হান যেন পুষ্টিকর খাবার পায়। যখন রায়হান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো, তার মুখ দেখে সুলতানা বেগমের চোখে আনন্দের অশ্রু ঝরেছিল। তিনি মনে মনে ভাবতেন, তার এতদিনের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে।
রায়হানও মাকে প্রচণ্ড ভালোবাসত। মায়ের আত্মত্যাগ সে বুঝতে পারত, যদিও পুরোপুরি উপলব্ধি করা তার পক্ষে তখনো সম্ভব ছিল না। মায়ের মুখের দিকে তাকালেই সে মায়ের গভীর ভালোবাসার ছাপ দেখতে পেত। তাদের সম্পর্কটি ছিল অনেকটা একটি নীরব বোঝাপড়ার মতো। অনেক কথা তাদের মধ্যে বলা না হলেও, একে অপরের অনুভূতি তারা সহজেই বুঝতে পারত। সুলতানা বেগম রায়হানকে কেবল সন্তান হিসেবে দেখতেন না, দেখতেন তার আত্মার অংশ হিসেবে। তার কাছে রায়হানের সুখই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুখ, আর রায়হানের দুঃখই ছিল তার সবচেয়ে বড় কষ্ট। এই ভালোবাসাই ছিল সুলতানা বেগমের জীবনের চালিকা শক্তি, যা তাকে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার সাহস দিত। তার কাছে রায়হানের সুস্থ জীবন এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ছিল তার সমস্ত প্রার্থনা ও অস্তিত্বের মূল কেন্দ্রবিন্দু।
রায়হানের অসুস্থতা: অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়
রায়হানের জীবন যখন তারুণ্যের ঝলকে উদ্ভাসিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনায় যখন সে মগ্ন, তখনই এক অপ্রত্যাশিত বিপর্যয় নেমে এল। সে তখন তার স্বপ্ন পূরণের পথে দ্রুত এগিয়ে চলছিল। একজন বড় বিজ্ঞানী হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার চোখেমুখে স্পষ্ট। কিন্তু নিয়তির পরিহাসে, একদিন হঠাৎ করেই তার শরীর খারাপ হতে শুরু করল। প্রথমে হালকা জ্বর, শরীর ম্যাজম্যাজ করা—সাধারণত যেমনটা হয়। সুলতানা বেগম প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো আবহাওয়ার পরিবর্তনে হয়েছে, বা পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপের কারণে দুর্বলতা। তিনি ঘরোয়া টোটকা আর মায়ের মমতার পরশ দিয়ে রায়হানকে সুস্থ করার চেষ্টা করছিলেন। গরম দুধ, তুলসী পাতার রস, প্যারাসিটামল—সবই তিনি নিয়ম করে দিতেন।
কিন্তু কয়েক দিন পেরিয়ে গেলেও রায়হানের অবস্থার উন্নতি হলো না, বরং খারাপের দিকে যেতে থাকল। জ্বর কমে আসার বদলে আরও বাড়তে লাগল, আর এর সাথে যোগ হলো তীব্র দুর্বলতা। রায়হান বিছানা থেকে উঠতেই পারত না। তার শরীর ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছিল, আর চোখ কোঠরগত। সবচেয়ে উদ্বেগজনক লক্ষণ ছিল শ্বাসকষ্ট। সামান্য পরিশ্রমেই তার শ্বাস নিতে কষ্ট হতো, এমনকি শুয়ে থাকলেও সে হাঁপাতে শুরু করত। সুলতানা বেগমের মনে অজানা এক আতঙ্ক দানা বাঁধতে শুরু করল। তার মাতৃ হৃদয় তাকে বলছিল, এ কোনো সাধারণ অসুস্থতা নয়।
রায়হানের বাবাও ছেলের এমন অবস্থা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তারা আর দেরি না করে দ্রুত রায়হানকে শহরের একটি বড় হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর ডাক্তার রায়হানকে দেখে কিছু প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষার নির্দেশ দিলেন। রক্তের চাপ পরিমাপ করা হলো, শরীরের তাপমাত্রা দেখা হলো, এবং কিছু সাধারণ রক্ত পরীক্ষা করানো হলো। প্রাথমিক রিপোর্টগুলো দেখে ডাক্তারদের কপালে চিন্তার রেখা দেখা গেল। রায়হানের রক্তে ক্রিয়েটিনিন এবং ইউরিয়ার মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেশি ছিল, যা কিডনির কার্যক্ষমতা হ্রাসের ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
রোগ নির্ণয়: এক ভয়াবহ সত্যের উন্মোচন
প্রাথমিক পরীক্ষার ফলাফলের পর ডাক্তাররা আরও বিশদ পরীক্ষার প্রয়োজন অনুভব করলেন। রায়হানের ইউরিন টেস্ট, কিডনির আল্ট্রাসাউন্ড, এবং কিছু বিশেষ রক্ত পরীক্ষা যেমন জি.এফ.আর (Glomerular Filtration Rate) পরীক্ষা করা হলো। প্রতি মুহূর্তে সুলতানা বেগম আর রায়হানের বাবা উৎকণ্ঠায় ভুগছিলেন। সুলতানা বেগম নীরবে প্রার্থনা করছিলেন, যেন তার ছেলের গুরুতর কিছু না হয়। হাসপাতালের করিডোরে বসে তারা প্রতিটা মিনিটের অপেক্ষাকে এক একটা বছরের মতো মনে করছিলেন।
অবশেষে সব রিপোর্ট হাতে নিয়ে ডাক্তার তাদের ডাকলেন। ডাক্তারের গম্ভীর মুখ দেখে সুলতানা বেগমের বুক ধড়ফড় করে উঠল। ডাক্তার যা বললেন, তা যেন বজ্রপাতের মতো শোনাল। তিনি বললেন, "দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, রায়হানের দুটি কিডনিই বিকল হয়ে গেছে। এটি ক্রনিক কিডনি ফেইলিউরের শেষ ধাপ।" এই কথা শুনে সুলতানা বেগমের পায়ের নিচে যেন মাটি সরে গেল। তার সারা শরীর অবশ হয়ে এল, চোখে অন্ধকার নেমে এল। তার জীবনে যত দুঃখ-কষ্ট এসেছে, এর কোনোটার সাথেই যেন এই ধাক্কার তুলনা চলে না। রায়হানের বাবাও স্তব্ধ হয়ে গেলেন, তার চোখেমুখে রাজ্যের হতাশা।
ডাক্তার বোঝালেন যে, রায়হানের কিডনি এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে, সেগুলো শরীরের বর্জ্য পদার্থ আর বিষাক্ত উপাদান ফিল্টার করতে পারছে না। ফলে এই বিষাক্ত পদার্থগুলো রায়হানের শরীরে জমা হয়ে তার অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি করছে। শ্বাসকষ্ট, দুর্বলতা—এগুলো সবই কিডনি অকার্যকর হওয়ার লক্ষণ। ডাক্তার আরও বললেন, "এই মুহূর্তে রায়হানকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হলো তাৎক্ষণিক কিডনি প্রতিস্থাপন (Kidney Transplant) অথবা নিয়মিত ডায়ালাইসিস।" ডায়ালাইসিস একটি সাময়িক সমাধান হলেও, দীর্ঘমেয়াদী সুস্থ জীবনের জন্য প্রতিস্থাপনই সর্বোত্তম।
এই খবর সুলতানা বেগমকে একেবারে ভেঙে দিলেও, তিনি মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলেন। তার একমাত্র সন্তানের জীবন যখন ঝুঁকির মুখে, তখন ভেঙে পড়া তার সাজে না। তার মনে তখন একটাই চিন্তা, কীভাবে তার রায়হানকে সুস্থ করে তোলা যায়, কীভাবে তার জীবনের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। তার ভালোবাসার শক্তিই তাকে এই ভয়াবহ সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সাহস জুগিয়েছিল।
কিডনি প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত: মায়ের অটল সংকল্প
রায়হানের দুটি কিডনিই বিকল হয়ে যাওয়ার খবর সুলতানা বেগমকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে দিলেও, তিনি মুহূর্তের জন্যও ভেঙে পড়েননি। ডাক্তারের কথাগুলো তার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল – "তাৎক্ষণিক কিডনি প্রতিস্থাপন প্রয়োজন।" এই কথাটি তার মনে এক নতুন আশার আলো জ্বেলে দিল, কারণ এর অর্থ হলো, রায়হানকে বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু একই সাথে এটি ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। কিডনি প্রতিস্থাপন একটি জটিল এবং ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, একজন উপযুক্ত দাতার সন্ধান।
ডাক্তাররা যখন সম্ভাব্য দাতার বিষয়ে আলোচনা করছিলেন, তখন সুলতানা বেগম এক মুহূর্তও দ্বিধা করেননি। তিনি সরাসরি ডাক্তারকে বললেন, "আমার কিডনি পরীক্ষা করে দেখুন। আমি আমার ছেলেকে কিডনি দিতে চাই।" তার এই কথা শুনে রায়হানের বাবা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা হতবাক হয়ে গেলেন। তারা জানতেন, সুলতানা বেগম রায়হানকে কতটা ভালোবাসেন, কিন্তু নিজের জীবন বিপন্ন করে এমন একটি বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া তাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল।
রায়হানের বাবা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, "সুলতানা, তুমি কী বলছো? তোমার তো আরও অনেক বয়স বাকি। নিজের জীবন কেন বিপন্ন করবে? আমরা অন্য দাতার খোঁজ করি।" রায়হানের চাচা, ফুফু এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনরাও একই কথা বলতে লাগলেন। তারা যুক্তি দেখালেন যে, সুলতানা বেগমের বয়স হয়েছে, তার শরীর দুর্বল, এবং একটি কিডনি নিয়ে বাকি জীবন কাটানো তার জন্য কতটা কঠিন হবে। তারা ভয় পাচ্ছিলেন, যদি অস্ত্রোপচারের সময় কোনো জটিলতা হয়, তাহলে কী হবে?
কিন্তু সুলতানা বেগম ছিলেন তার সিদ্ধান্তে অটল। তার চোখেমুখে ছিল এক দৃঢ় সংকল্প। তিনি শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, "আমার রায়হান যদি বেঁচে না থাকে, তাহলে আমার এই জীবন দিয়ে কী হবে? ও আমার একমাত্র সন্তান। ওর জীবন বাঁচানোর জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি আছি। আমার কিডনি যদি ওর কাজে আসে, এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আমার আর কী হতে পারে?" তার এই কথাগুলো শুনে সবাই নীরব হয়ে গেলেন। তারা বুঝতে পারলেন, সুলতানা বেগমের ভালোবাসার গভীরতা কতটা। কোনো যুক্তি, কোনো ভয় তাকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারবে না।
ডাক্তাররা সুলতানা বেগমের এই ইচ্ছাকে সম্মান জানালেন এবং তার শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন। বিভিন্ন রক্ত পরীক্ষা, টিস্যু ম্যাচিং, এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হলো। সবার মনেই একটা চাপা উত্তেজনা ছিল – সুলতানা বেগমের কিডনি রায়হানের সাথে মিলবে তো? কয়েক দিন পর যখন রিপোর্ট এল, তখন ডাক্তাররা জানালেন, "সুলতানা বেগমের কিডনি রায়হানের সাথে সম্পূর্ণ মিলে গেছে। তিনি একজন উপযুক্ত দাতা।" এই খবর শুনে হাসপাতালে এক আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। সুলতানা বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, তার চোখে ছিল এক ভিন্ন রকম আনন্দ।
প্রস্তুতি: আশা আর উদ্বেগের মিশ্রণ
কিডনি ম্যাচিংয়ের খবর পাওয়ার পর অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতি শুরু হলো। এটি একটি দীর্ঘ এবং সতর্কতামূলক প্রক্রিয়া ছিল। ডাক্তাররা সুলতানা বেগম এবং রায়হান উভয়কেই বিস্তারিতভাবে অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি, প্রক্রিয়া এবং পরবর্তী যত্নের বিষয়ে বোঝালেন। সুলতানা বেগমকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার জন্য কাউন্সেলিংও করা হলো। তিনি প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন, তার মনে কোনো ভয় ছিল না, ছিল শুধু রায়হানের সুস্থ জীবনের প্রার্থনা।
অস্ত্রোপচারের জন্য একটি নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক করা হলো। এই সময়ের মধ্যে রায়হানকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস দেওয়া হচ্ছিল, যাতে তার শরীর অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্তুত থাকে। সুলতানা বেগমও নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ যত্ন নিচ্ছিলেন। পুষ্টিকর খাবার খাচ্ছিলেন, ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলছিলেন। পরিবারের সদস্যরাও তাদের পাশে ছিলেন, সাহস যোগাচ্ছিলেন।
হাসপাতালের পরিবেশ ছিল আশা আর উদ্বেগের এক মিশ্রণ। একদিকে রায়হানকে সুস্থ করে তোলার আশা, অন্যদিকে একটি বড় অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি। সুলতানা বেগম রায়হানের পাশে বসে তাকে সাহস দিতেন। রায়হানও তার মায়ের এই আত্মত্যাগ দেখে গভীরভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ত। সে বারবার মাকে বলত, "মা, তুমি আমার জন্য এত কিছু করছো। আমি জানি না তোমার ঋণ কীভাবে শোধ করব।" সুলতানা বেগম শুধু হাসতেন আর বলতেন, "পাগলা ছেলে! মায়ের কাছে আবার কিসের ঋণ? তুই সুস্থ হয়ে উঠলেই আমার সব সার্থকতা।"
অস্ত্রোপচারের আগের রাতে সুলতানা বেগম নির্ঘুম কাটালেন। তিনি বারবার আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিলেন, যেন সবকিছু নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়, যেন তার রায়হান আবার সুস্থ জীবনে ফিরে আসে। তার মনে কোনো স্বার্থপরতা ছিল না, ছিল শুধু নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। তিনি জানতেন, এই অস্ত্রোপচার কেবল রায়হানের জীবন বাঁচাবে না, বাঁচাবে তার নিজের স্বপ্নকেও।
পরের দিন সকালে, অস্ত্রোপচারের জন্য সুলতানা বেগমকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো। তার মুখে ছিল এক শান্ত হাসি, চোখে ছিল এক অদম্য শক্তি। তিনি জানতেন, এই ত্যাগ বৃথা যাবে না।
অস্ত্রোপচার: আশার আলো আর উদ্বেগের দোলাচল
অস্ত্রোপচারের দিনটি ছিল রায়হানের পরিবার এবং বিশেষ করে সুলতানা বেগমের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। সকাল থেকেই হাসপাতালের করিডোরে চাপা উত্তেজনা। সুলতানা বেগমকে যখন অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তার মুখে ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি। ভয় নয়, বরং এক দৃঢ় সংকল্প আর সন্তানের জন্য ভালোবাসা তার চোখে স্পষ্ট ছিল। রায়হানও তার মাকে হাসিমুখে বিদায় জানাল, যদিও তার নিজের ভেতরে তখন এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল— মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা এবং নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক অজানা শঙ্কা।
অস্ত্রোপচার কক্ষের বাইরে রায়হানের বাবা এবং অন্যান্য স্বজনেরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিলেন। সময় যেন কাটছিলই না। প্রতিটি মিনিট মনে হচ্ছিল এক একটি যুগ। ডাক্তাররা ভেতরে নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করছিলেন। এটি ছিল একটি দীর্ঘ এবং জটিল প্রক্রিয়া, যেখানে একই সময়ে দুটি অস্ত্রোপচার চলছিল—একদিক থেকে সুলতানা বেগমের শরীর থেকে একটি কিডনি বের করা হচ্ছিল, এবং অন্যদিকে সেই কিডনিটি রায়হানের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছিল।
বেশ কয়েক ঘণ্টা পর, অপারেশন থিয়েটারের দরজা খুলল। একজন সিনিয়র ডাক্তার বাইরে এসে জানালেন, "অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে। সুলতানা বেগম এবং রায়হান দুজনেই আপাতত সুস্থ আছেন। তবে, তাদের দু'জনকেই নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।" এই খবর শুনে পরিবারের সদস্যদের মুখে স্বস্তির হাসি ফুটে উঠল। তাদের চোখে ছিল আনন্দের অশ্রু। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন সবাই।
সুলতানা বেগমকে প্রথমে রিকভারি রুমে এবং পরে সাধারণ কেবিনে স্থানান্তরিত করা হলো। জ্ঞান ফেরার পর তিনি প্রথমেই রায়হানের খোঁজ নিলেন। যখন তাকে জানানো হলো রায়হান ভালো আছে, তখন তার মুখে এক পরম তৃপ্তির হাসি দেখা গেল। তার নিজের ব্যথা বা অস্বস্তি নিয়ে তার কোনো অভিযোগ ছিল না। অন্যদিকে, রায়হানকেও আইসিইউ থেকে কেবিনে আনা হলো। তার চোখে ছিল মায়ের প্রতি সীমাহীন কৃতজ্ঞতা।
আরোগ্যলাভ এবং মা-ছেলের সম্পর্কের নতুন অধ্যায়
অস্ত্রোপচারের পরের দিনগুলো ছিল ধীরে ধীরে আরোগ্যলাভের সময়। সুলতানা বেগম এবং রায়হান দু'জনেরই নিবিড় পরিচর্যা প্রয়োজন ছিল। সুলতানা বেগমের শরীর থেকে একটি কিডনি চলে যাওয়ায় তার কিছু দুর্বলতা ছিল, কিন্তু তার মনোবল ছিল অটুট। তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। তার মনে একটাই আনন্দ ছিল—তার রায়হান নতুন জীবন পেয়েছে।
রায়হানের সুস্থতা ছিল আরও তাৎপর্যপূর্ণ। ধীরে ধীরে তার শ্বাসকষ্ট কমে আসতে লাগল, শরীরিক দুর্বলতাও কাটতে শুরু করল। নতুন কিডনি কাজ করতে শুরু করায় তার শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থগুলো বেরিয়ে যাচ্ছিল। কয়েক দিন পর রায়হান যখন প্রথমবারের মতো নিজে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে পারল, তখন সুলতানা বেগম এক স্বর্গীয় আনন্দ অনুভব করলেন। এই দৃশ্যটি তার কাছে ছিল সব ত্যাগের চূড়ান্ত সার্থকতা।
হাসপাতালে থাকার সময় মা-ছেলের বন্ধন আরও গভীর হলো। রায়হান তার মায়ের আত্মত্যাগ আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারল। সে দেখল, মা নিজের জীবনকে বাজি রেখে তাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। সে মাকে নিজের হাতে খাবার খাইয়ে দিত, তার পাশে বসে গল্প করত। তাদের চোখাচোখি হলেই এক নীরব বোঝাপড়া তৈরি হতো, যেখানে ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা এবং অবিচল আস্থা প্রকাশ পেত। রায়হান মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শপথ করত, সে মায়ের এই আত্মত্যাগ কোনোদিন বৃথা যেতে দেবে না। সে তার স্বপ্ন পূরণ করবে, একজন সফল মানুষ হবে, যাতে মা তার জন্য গর্ব করতে পারেন।
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর তাদের জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন এল। সুলতানা বেগমকে একটি কিডনি নিয়েই চলতে হচ্ছিল, তাই তার স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে হতো। রায়হানও তার মায়ের প্রতি আরও বেশি যত্নশীল হয়ে উঠল। সে নিজের হাতে মায়ের ওষুধ গুছিয়ে দিত, মায়ের পছন্দের খাবার রান্না করতে সাহায্য করত। তাদের বাড়িতে এখন শুধু ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতার আবহ ছিল।
রায়হান আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেল। এবার তার পড়াশোনায় আরও বেশি মনোযোগ ছিল, আরও বেশি অধ্যবসায়। সে জানত, এটি কেবল তার নিজের স্বপ্ন নয়, এটি তার মায়ের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানানোর একটি উপায়। সে প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো ফল করতে লাগল, নতুন নতুন আবিষ্কারের দিকে ঝুঁকতে লাগল। সুলতানা বেগম দূর থেকে ছেলের প্রতিটি সাফল্যে গর্বিত হতেন, আর নীরবে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতেন।
এই ঘটনাটি সুলতানা বেগম এবং রায়হানের মা-ছেলের সম্পর্ককে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। এটি কেবল রক্ত সম্পর্কের বন্ধন ছিল না, ছিল আত্মত্যাগ, ভালোবাসা, এবং অসীম কৃতজ্ঞতার এক অমর গাথা। সুলতানা বেগমের এই আত্মত্যাগ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মা-ছেলের ভালোবাসার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।