অচেনা সুর, চেনা অনুভূতি

অচেনা সুর, চেনা অনুভূতি

কলেজের করিডোরে সেদিন অন্য দিনের চেয়ে একটু বেশি ভিড় ছিল। নতুন সেমিস্টারের শুরু, আর তার সাথে নতুন কিছু মুখ। আবির এসবের মধ্যে নিজের চিন্তায় মগ্ন ছিল। গিটারটা কাঁধে ঝুলিয়ে সে যাচ্ছিল মিউজিক ক্লাসের দিকে। ওর ধ্যান ভেঙে দিল একটা মিষ্টি সুর। কে যেন পিয়ানো বাজাচ্ছে, কিন্তু সে সুরটা এত পরিচিত, এত মন ছুঁয়ে যাওয়া, যেন আবিরের বহুদিনের ফেলে আসা কোনো স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলছে।

শব্দের উৎস খুঁজতে খুঁজতে আবির এসে দাঁড়াল মিউজিক রুমের দরজায়। ভেতরে এক মেয়ে পিয়ানো বাজাচ্ছে। পরনে সাদা সালোয়ার-কামিজ, খোলা চুলগুলো পিঠের উপর ছড়িয়ে আছে। তার হাতের জাদুতে পিয়ানোর সাদা-কালো কি-গুলো থেকে বেরিয়ে আসছে এক অদ্ভুত মায়াবী সুর। আবির মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে রইল। সুরটা শেষ হতেই মেয়েটি ঘুরে তাকাল, আর আবিরের চোখে চোখ পড়ল। এক পলকে যেন সময়ের চাকা থেমে গেল। মেয়েটির নাম অহনা, আর সেদিনই তাদের প্রথম দেখা।

প্রথম দিকে তাদের সম্পর্কটা ছিল শুধুই মিউজিকের। আবির গিটার বাজাতো, অহনা পিয়ানো। ক্লাসের ফাঁকে, ক্যান্টিনে, এমনকি কলেজের বাগানেও তারা সুরের আদান-প্রদান করত। আবির দেখত অহনার চোখে স্বপ্নের ঝিলিক, আর অহনা মুগ্ধ হয়ে শুনত আবিরের গিটারের মূর্ছনা। ধীরে ধীরে সুরের আড়ালে তাদের অজান্তেই এক অন্য সুর বাজতে শুরু করল – ভালোবাসার সুর।

একদিন আবির তার নতুন একটা কম্পোজিশন শোনাতে অহনাকে ডেকেছিল কলেজ অডিটোরিয়ামে। মিউজিক শেষ হওয়ার পর অহনা হাততালি দিয়ে উঠল। আবির একটু লজ্জা পেয়েছিল। অহনা তখন বলল, "তোমার গিটারে শুধু সুরই নেই, একটা গল্পও আছে। তোমার সব গানে একটা মন ছুঁয়ে যাওয়া অনুভূতি থাকে।"

আবির অহনার চোখে চোখ রেখে বলল, "আমার গানের প্রেরণা তো তুমিই।"

অহনার গাল দুটো রাঙা হয়ে উঠল। এরপর তাদের মধ্যেকার নীরবতাটা যেন আরও গভীর কিছু বলে যাচ্ছিল। সেদিনই তারা একে অপরের প্রতি তাদের অনুভূতির কথা প্রথমবার স্বীকার করল। সেই দিন থেকে তাদের সম্পর্কটা আর শুধু সুরের ছিল না, তা পরিণত হয়েছিল এক গভীর ভালোবাসায়।

কলেজ শেষ হওয়ার পর আবির আর অহনার পথ কিছুটা আলাদা হয়েছিল। আবির মিউজিক প্রোডাকশনের কাজে যুক্ত হয়েছিল, আর অহনা বেছে নিয়েছিল শিক্ষকতা। ব্যস্ততার মাঝেও তারা একে অপরের জন্য সময় বের করত। লং ড্রাইভ, বৃষ্টিভেজা বিকেলে কফি শপে আড্ডা, বা পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন – তাদের ভালোবাসার বাঁধন যেন সময়ের সাথে আরও মজবুত হচ্ছিল।

এক বর্ষার সন্ধ্যায়, আবির অহনাকে নিয়ে গেল তাদের সেই পুরনো মিউজিক রুমের সামনে, যেখানে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। রুমটা তখন বন্ধ ছিল, কিন্তু বাইরে দাঁড়িয়েই আবির তার গিটারটা বের করল। অহনা বুঝতে পারল, আবির আজ এক নতুন সুর শোনাবে।

আবির গিটারের তারে আলতো করে হাত বোলাল, আর এক মিষ্টি সুর ভেসে এল বাতাসে। সুরটা ছিল তাদের ভালোবাসার গল্প, তাদের প্রথম দেখা থেকে শুরু করে আজকের এই দিন পর্যন্ত। সুরের মাঝেই আবির অহনার হাত ধরে বলল, "তোমার সাথে পরিচয় হওয়ার পর আমার জীবনে সুরের নতুন মানে খুঁজে পেয়েছি। তুমি আমার গানের প্রতিটা লাইন, আমার প্রতিটা নোট। বাকি জীবনটা কি আমার সাথেই থাকবে, অহনা?"

অহনার চোখ জলে ভরে উঠল। সে আবিরকে জড়িয়ে ধরল, আর ফিসফিস করে বলল, "শুধু গান নয়, জীবনের প্রতিটা ধাপে আমি তোমার সাথেই থাকতে চাই, আবির।"

বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ছিল তাদের মুখে, আর সেই বৃষ্টির মধ্যেই তাদের ভালোবাসার নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। তাদের গল্পটা হয়তো আর পাঁচটা প্রেমের গল্পের মতো সাধারণ নয়, কারণ এর পরতে পরতে মিশে আছে সুর, অনুভূতি আর এক চিরন্তন ভালোবাসা, যা সময়ের সাথে সাথে আরও গভীর হয়েছে।

গল্পটি আপনার কেমন লেগেছে? 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.