আয়নার ওপারে

আয়নার ওপারে

সন্ধ্যা নেমে আসছিল। শহরের কোলাহল তখনও পুরোপুরি থামেনি, কিন্তু অনিকের অ্যাপার্টমেন্টের ঘরে একটা অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছিল। সে একটা পুরনো আসবাবপত্রের দোকান থেকে একটি অ্যান্টিক আয়না কিনেছিল আজ দুপুরে। আয়নাটা ছিল বেশ বড়, সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো, আর তার কাঁচের মধ্যে কেমন যেন একটা গভীরতা ছিল, যা অনিককে ভীষণভাবে আকর্ষণ করেছিল।

আয়নাটাকে সে তার বসার ঘরের একটা ফাঁকা দেয়ালে টাঙিয়ে দিল। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আয়নাটা টাঙানোর পর থেকেই অনিকের কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। মনে হচ্ছিল যেন কেউ তাকে দেখছে। সে কয়েকবার পিছন ফিরে তাকাল, কিন্তু ঘরে আর কেউ ছিল না।

রাত বাড়ার সাথে সাথে অস্বস্তিটা আরও বাড়তে লাগল। অনিক তার ল্যাপটপে কাজ করতে বসল, কিন্তু তার চোখ বারবার আয়নার দিকে চলে যাচ্ছিল। আয়নার ভেতরে তার নিজের প্রতিচ্ছবিকে কেমন যেন অপরিচিত লাগছিল। তার চোখগুলো আরও গভীর, আরও নির্জীব দেখাচ্ছিল।

হঠাৎ করেই আয়নার ভেতর থেকে একটা ফিসফিস শব্দ অনিকের কানে এল। সে চমকে উঠল, তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত তালে ধুকপুক করতে লাগল। সে ভাবল হয়তো তার মনের ভুল, কিন্তু শব্দটা আবার শোনা গেল, এবার আরও স্পষ্ট। যেন কেউ তার নাম ধরে ডাকছে, "অনিক... অনিক..."

ভয়ে অনিকের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল। সে ধীরে ধীরে আয়নার দিকে এগিয়ে গেল। আয়নার ভেতরে তার প্রতিচ্ছবিটা যেন একটু হেসে উঠল, সেই হাসিটা ছিল অস্বাভাবিক, বিভীষিকাময়। আয়নার ভেতর থেকে এবার স্পষ্ট একটি কণ্ঠস্বর শোনা গেল, "কাছে আয়... আমার কাছে আয়..."

অনিক যেন সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিল। সে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আয়নার দিকে আরও এক পা বাড়াল। তার হাতটা যখন আয়নার কাঁচ স্পর্শ করল, তখন সে অনুভব করল একটা হিমশীতল স্পর্শ। কাঁচটা যেন গলে যাচ্ছিল, আর তার হাতটা ধীরে ধীরে আয়নার ভেতরে প্রবেশ করছিল।

ভয়ে অনিকের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। সে চাইলেও হাতটা টেনে বের করতে পারল না। পুরো শরীরটা যেন আয়নার গভীরে টেনে যাচ্ছিল। তার মনে হলো সে যেন এক অচেনা, অন্ধকার জগতে প্রবেশ করছে। চারদিকে শুধু আঁধার আর একটা ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে অনুভূতি।

তারপর সে দেখল, আয়নার ওপারে একটা আবছা অবয়ব তার দিকে এগিয়ে আসছে। সেটা ছিল একজন নারীর প্রতিচ্ছবি, তার চুলগুলো এলোমেলো, চোখগুলো কোটরাগত আর মুখে একটা বীভৎস হাসি। তার পোশাক ছিল পুরনো, ছেঁড়াখোঁড়া। নারীটি অনিকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, তার হাতের নখগুলো ছিল লম্বা আর ধারালো।

অনিক প্রাণপণে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু তার গলা থেকে কোনো শব্দ বের হলো না। সে অনুভব করল নারীটি তার হাতটা ধরেছে, আর তার শীতল স্পর্শে অনিকের শরীরের সমস্ত রক্ত যেন জমে গেল। নারীটি তাকে তার দিকে আরও জোরে টানতে লাগল।

পরদিন সকালে অনিকের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা ছিল। প্রতিবেশীরা এসে দেখল ফ্ল্যাটটা খালি। আসবাবপত্র সবই ঠিকঠাক আছে, শুধু বসার ঘরের দেয়ালে থাকা অ্যান্টিক আয়নাটা উধাও। আর আয়না যেখানে ছিল, সেই জায়গায় দেয়ালে একটা কালচে দাগ, যেটা দেখতে অনেকটা হাতছাপের মতো।

অনিকের বন্ধুরা, আত্মীয়-স্বজন তাকে অনেক খুঁজেছিল, কিন্তু তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। লোকমুখে শোনা যায়, সেই অ্যান্টিক আয়না নাকি আসলে এক অভিশপ্ত আয়না। যে তার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তাকে নাকি আয়নার ওপারে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, এক ভয়ংকর জগতে, যেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসে না। আর অনিক, সে হয়তো আজও সেই আয়নার ওপারে বন্দী, এক অতৃপ্ত আত্মার হাতে।

গল্পটি পড়ে কেমন লাগল?


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.