নিশাচর কুটির
সূর্য তখন অস্তাচলে, রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ছিল দিগন্তে। জীর্ণ পথের দু'ধারে ঘন গাছপালা, দিনের আলোতেও যেখানটায় কেমন একটা গা ছমছমে ভাব লেগে থাকে। রাত বাড়ার সাথে সাথে সে আঁধার যেন আরও গভীর হয়। এই পথ ধরেই হেঁটে যাচ্ছিল অর্ঘ্য আর তার বন্ধুরা – রিয়া, সুমন আর তানিয়া। শহরের কোলাহল ছেড়ে তারা বেরিয়েছিল অজানার টানে, গন্তব্য ছিল পাহাড়ি এলাকার এক নির্জন গ্রাম। কিন্তু পথ ভুল করে তারা এসে পড়েছিল এক পরিত্যক্ত কুটিরের সামনে।
কুটিরটি যেন সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তার ভাঙা দেয়াল আর কঙ্কালসার ছাদ জানান দিচ্ছিল বহু বছর ধরে এর কোনো বাসিন্দা নেই। চারপাশের গাছপালা লতাপাতায় এমনভাবে ঢেকে রেখেছিল যেন প্রকৃতি নিজেই একে গ্রাস করতে চাইছে। প্রবেশপথের মরচে পড়া লোহার গেটটা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে উঠল অর্ঘ্যর ধাক্কায়। ভেতরে ঢুকতেই পুরোনো ধুলোর গন্ধ আর স্যাঁতসেঁতে একটা অনুভূতি তাদের ঘিরে ধরল।
"দোস্ত, এইটা তো ভূতের বাড়ি মনে হচ্ছে!" ফিসফিস করে বলল সুমন, তার চোখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ।
রিয়া অবশ্য বেশ সাহসী ছিল। "আরে ধুর! ভূত বলে কিছু হয় নাকি? চল, ভেতরে গিয়ে দেখি।"
তাদের টর্চের আলোয় ঘরের ভেতরের সবকিছু স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। আসবাবপত্রগুলো ধুলোর আস্তরণে ঢাকা, মাকড়সার জাল আর ইঁদুরের উপদ্রব দেখে মনে হচ্ছিল বহু বছর ধরে এখানে কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই। হঠাৎ তানিয়া আর্তনাদ করে উঠল, "ওই দেখ!"
সবাই সেদিকে তাকাল। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল কিছু পুরোনো ভাঙা পুতুল, তাদের চোখগুলো যেন মৃত দৃষ্টিতে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। পুতুলগুলোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনো শিশু তাদের সাথে খেলার বদলে নির্মমভাবে নির্যাতন করেছে।
তারা যখন একটা ভাঙা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উপরের তলার দিকে উঠছিল, তখনই নিচ থেকে একটা খসখস শব্দ ভেসে এল। যেন কেউ শুকনো পাতার উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সুমন আর তানিয়া ভয়ে জমে গেল। অর্ঘ্য টর্চটা নিচ দিকে ধরল, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না।
"হাওয়া হতে পারে," রিয়া বোঝানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তার গলাতেও কেমন যেন কাঁপুনি।
উপরের তলায় একটা ভাঙা দোলনা ঝুলছিল। বাতাসের সামান্যতম আনাগোনা না থাকলেও দোলনাটা ধীরে ধীরে দুলছিল। তাদের বুকের ধুকপুকানি আরও বেড়ে গেল। হঠাৎ করেই ঘরের তাপমাত্রা কমে গেল, হিমশীতল একটা বাতাস তাদের পাশ দিয়ে বয়ে গেল।
এরপর যা ঘটল, তার জন্য তারা কেউই প্রস্তুত ছিল না। একটা নারীকণ্ঠের আর্তনাদ তাদের কানে এল, মনে হলো যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসছে। সেই আর্তনাদ ধীরে ধীরে তীব্র হয়ে উঠল, এক ভয়ংকর চিৎকারে পরিণত হলো। দেয়ালের ভাঙা কাঁচগুলো ঝনঝন করে উঠল, মনে হলো যেন কুটিরটা তাদের উপর ভেঙে পড়তে চাইছে।
সুমন আর তানিয়া ভয়ে চিৎকার করে সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল। অর্ঘ্য আর রিয়াও তাদের পিছু নিল, কিন্তু তখনি তাদের টর্চগুলো নিভে গেল। ঘোর অন্ধকারে তারা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল।
"অর্ঘ্য! রিয়া!" ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ডাকল সুমন।
কোনো উত্তর নেই। শুধু বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর তাদের নিজেদেরই হৃদস্পন্দনের আওয়াজ। হঠাৎই অর্ঘ্য অনুভব করল যেন ঠান্ডা, বরফ শীতল একটা হাত তার কাঁধে এসে পড়েছে। সে ভয়ে চিৎকার করে উঠল, কিন্তু তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হলো না।
এরপর রিয়া শুনতে পেল একটা ফিসফিসানি, যেন কেউ তার কানের কাছে বলছে, "তোমরাও থাকবে আমার সাথে..."
তারা আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করল না। অন্ধকারের মধ্যেই হাতড়ে হাতড়ে তারা দরজা খুঁজে বের করল এবং কোনোমতে বাইরে বেরিয়ে এলো। পিছনে ফিরে তাকানোর সাহস তাদের ছিল না। তারা দৌড়াতে শুরু করল, যত দ্রুত সম্ভব সেই নিশাচর কুটির থেকে দূরে সরে যেতে।
পরের দিন সকালে গ্রামের লোকজনকে তারা সেই কুটিরের কথা বলেছিল, কিন্তু গ্রামের লোকেরা শুধু মুচকি হেসেছিল। তারা বলেছিল, "ওই কুটিরে কেউ থাকে না বহু বছর ধরে। ওটা নাকি এক পাগল বুড়ির কুটির ছিল। যে তার মেয়েকে হারিয়ে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আর ওখানে কিছু নেই।"
কিন্তু অর্ঘ্য আর তার বন্ধুরা জানত, তারা যা দেখেছে, যা অনুভব করেছে, তা নিছকই মনের ভুল ছিল না। সেই নিশাচর কুটির, তার প্রতিটি ইট, প্রতিটি ফিসফিসানি যেন আজও কোনো এক অতৃপ্ত আত্মার উপস্থিতি জানান দেয়। আর সেই রাতের বিভীষিকা তাদের মনে আজও এক গভীর ক্ষত হয়ে রয়ে গেছে, যা তাদের সারা জীবন তাড়া করে ফিরবে।