জোনাকির আলোয় বোয়াল মাছ

জোনাকির আলোয় বোয়াল মাছ


চারদিকে সুনসান। আইজকা কাইলকা জোনাকির আলো তেমুন দেহন যায় না, তয় রাইত বিরাইতে হঠাৎ হঠাৎ দুই চাইরটা টিমটিম কইরা জ্বলে। আকাশে অবশ্য চান্দও আছে, তয় মেঘের আড়ালে লুকায়া আছে সেইটা। এমুন এক নিঝুম রাইতে, ছতু মিয়ার সেজো পোলা রাশেদ কইয়া উঠলো, "আব্বা, আমার ডর লাগে।" অন্যদিন তো রাশেদের এত ভয়ভয় লাগতো না, মাছ ধরতে আইসা বাপের লগে। তয় আইজকা কেমন জানি শরীলটা বারবার শিউরায়া উঠতাছে।

ছতু মিয়া মৃদু হাইসা কইলেন, "ক্যান রে বাজান? আমি তো আছি এইহানে, তোর লগে।"

ঠিক তহনই রাশেদ কেমন জানি উত্তেজিত হইয়া কইলো, "ও আব্বা, দেহো তো, জালের মইধ্যে কিজানি লড়তাছে! কি জোরে টান দিতাছে! তোলো আব্বা, বড় মাছ মনে হইতাছে!"

ছতু মিয়ার চোক্ষেও একটা চকমকানি আইলো। "হ রে বাপ, টান তো ভালোই দিতাছে। আইজকা মনে অয় আল্লাহ্ রহম করছে। দেহি তো টাইন্যা।"

বিসমিল্লাহ্ কইয়া ছতু মিয়া জালে টান দিলেন।

ছতু মিয়া, একজন বিটলা মানুষ। তার হরেক রকম পেশা। মৌসুমের লগে লগে তার পেশাও পাল্টায়। অভাবের সংসারে যতটা পারে, চেষ্টা কইরা নিজেদের অভাব মিটানোর চিন্তাই সবসময়। তাইতো তিনি থাইমা থাকেন না কোনোদিন।

ছতু মিয়ার পাঁচটা পোলাপান। চাইরটা পোলার ছোট এক মাইয়া। মাইয়াটার বয়স মাত্র দুই বছর। কেবল সামান্য দুই-চাইরটা কথা শিখছে। খুব দুষ্ট হলেও ভাইগো আর বাপ-মায়ের অনেক আদরের সে।

ছতু মিয়ার চাইর পোলা। বড় পোলা কবিরুল ইসলাম, তয় এখন সবাই "কবিরা" নামেই চিনে। তার বয়স ষোলো কি সতেরো হইবো। সে ভ্যানে কইরা সবজি বেইচা বেড়ায়।

তারপরের পোলার বয়স পনেরো বছর। নাম জহিরুল ইসলাম। সে বড় ভাইয়ের লগেই থাকে।

তার পরেরটা রাশেদুল ইসলাম। তার বয়স এইবার তেরো বছর। নম্রভদ্র পোলা হিসাবে এলাকায় তার নাম আছে। গ্রামের ইস্কুলে একটু লেখাপড়াও করছে, তয় অভাবের তাড়নায় সেইটা বেশিদূর আগাইতে পারে নাই।

ছোট পোলা রফিকুল ইসলাম। বয়স সবে আট বছর। সে অনেক দুষ্ট। সারাদিন হই-হুল্লোড় কইরা আর পাড়ার পোলাপানের লগে মারামারি, ঝগড়াঝাঁটি কইরাই দিন কাটাইয়া দেয়। আর মা আমেনা বেগমের হাতে রোজই মাইর খায়।

রাশেদরে সবাই খুব পছন্দ করে। ছতু মিয়াও মাছ ধরতে যাওয়ার সময় রাশেদরে লগে কইরা নিয়া যায়। সারারাত মাছ ধরে, ফজরের আজানের আগে ফিরা আসে। সকালে সেইগুলা বেইচা ঘরের জন্য বাজার-সওদা করে। তয় আজকাল আর আগের মতো মাছ পাওন যায় না দেইখা আয়-রোজগার অনেক কম।

তাছাড়া ঘরের অবস্থাও খুব একটা ভালো না। এই বর্ষায় ঘরটা টিকবো কিনা সন্দেহ আছে। ছতু মিয়ার অবশ্য ইচ্ছে, এইবার একটা টিনের ঘর তুলবো। গ্রামের সবারই টিনের ঘর আছে। আবার মজিদ মাতবরের তো একতলা দালানও আছে একটা। শুধু ছতু মিয়ারই বেড়ার ঘর। চালে অবশ্য টিন দেওয়া আছে, তয় অনেক পুরান হইয়া গেছে। মরিচা ধইরা এখন ভাইঙ্গা ভাইঙ্গা পড়তাছে। তাই এইবার অনেক পরিশ্রম করতাছে কিছু টেকা জমানোর জন্য, একটা ঘর দিবো। পোলাপানগুলাও অনেক পরিশ্রম করে। ছতু মিয়াকে খুব ভয় পায় সব পোলাপান। আমেনা বেগম তো বাঘের মতোন ভয় পায় ছতু মিয়াকে।

ছতু মিয়া জাল টান দিতেই বুঝতে পারলেন, বড় মাছ হইবো। খুশি মনে জাল টাইনা উঠাইলেন। উঠানোর পরই ছতু মিয়ার মুখ খুশিতে ভইরা গেল। এইদিকে রাশেদ স্টিলের তিন ব্যাটারির টর্চলাইটটা জালের উপর মাইরা দেখলো, আস্ত বোয়াল মাছ! ওজন কম কইরা হইলেও দুই-আড়াই কেজি হইবো। রাশেদ তো খুশিতে আটখানা। ছতু মিয়াও অনেক খুশি। সাবধানে জাল টাইনা বোয়ালটারে ঝুড়িতে না রাইখা বস্তায় ভইরা রাখলেন।

এইদিকে সারারাইত আর খুব একটা সুবিধা করতে পারলেন না। কেবল কয়টা ছোট ছোট শোল, টাকি আর পুঁটি মাছই পাইলো। তবুও ছতু মিয়া অনেক খুশি। ভোরের ফজরের আজান হওয়ার পর বাপ-বেটা মিলা বাড়ির দিকে রওনা দিলো। পাড়ার দোকানের ওইদিক দিয়া আইতে হয়। দোকানের কাছে আইতেই মজিদ মাতবরের লগে ছতু মিয়ার দেখা।

প্রতিদিন বেশিরভাগ মাছগুলা সাধারণত মজিদ মাতবরই কিনে নেয়। তাছাড়া এলাকার মুরব্বি আর গণ্যমান্য হিসাবে মজিদ মাতবরের যথেষ্ট নামডাক আছে। বিপদে-আপদে পাড়ার মাইনষের শেষ ভরসা মজিদ মাতবর। লোকটা সুদে টেকা খাটাইয়া অনেক সহায়-সম্পদ গইড়া তুলছে। তয় যাই হোক, মজিদ মাতবর এলাকার বিশিষ্ট মানুষ আর সকলের শ্রদ্ধাভাজন।

মাতবর আইজকা ছতু মিয়াকে খুশি দেইখা জিগাইলো, "কিরে ছত্তা? আইজকা মনে অয় বোয়াল ধরলি, এত খুশি লাগতাছে তরে।"

ছতু মিয়া সলজ্জ হাইসা কইলেন, "জ্বী মাতবর কাকা, আজকা সত্যি সত্যিই বোয়াল ধরছি।"

"কস কি, কই দেখি তো তোর বোয়াল মাছডারে।" এই কথা বইলা মজিদ মাতবর ছতু মিয়ারে ইশারা করলেন মাছের ঝুড়ি দেখাইতে।

মজিদ মিয়া দেইখা কইলেন, "আরে ছত্তা, তুই তো আইজকা বহুত বড় বোয়াল পাইলি দেখতাছি। যা যা, এই বোয়াল তুই আর কই নিবি, তোর চাচির আবার বড় মাছ বেশি পছন্দের। যাইয়া এইডা তোর চাচির কাছে দিয়া আয়।"

ছতু মিয়ার মুখ কালো হইয়া গেল। সে তো আরো ভাবতাছিলো এই বোয়াল আইজকা সবাই মিলা ঘরের। তয় মাতবরের সামনে কিছু কওনের তার সাহস নাই। তাই মাছটা রাশেদের হাতে দিয়া কইলো, "যা রে রাশেদ, এইটা তোর দাদির কাছে দিয়া আয়।"

(কাছেই মজিদ মাতবরের বিশাল বাড়ি)

রাশেদ বোয়াল মাছটা নিয়া মাতবরের বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো। ছতু মিয়ার বুঁকে একটা চাপা কষ্ট দানা বাঁধলো। এমুন একটা বড় মাছ, যা দিয়া হয়তো পুরো পরিবারের জন্য দু'বেলার খাবারের জোগাড় হইতো, সেইটা এমুন কইরা হাতছাড়া হইয়া গেল। কিন্তু মাতবরের কথা অমান্য করনের সাহস তার নাই। গ্রামের মাতবরগো ক্ষমতা এমুনই। তাগো কথাতেই চলে সমাজ, তাগো ইশারায় ওঠে-বসে মানুষ। ছতু মিয়া অসহায়ভাবে খাড়ায়া রইলেন, রাশেদের দূরে মিলাইয়া যাওয়া ছোট ছায়াটার দিকে চাইয়া রইলেন।

সূর্য উঁকি দিতে শুরু করছে। হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা প্রকৃতি। ছতু মিয়া মনমরা হইয়া বাকি ছোট মাছগুলা নিয়া বাড়ির পথে পা বাড়াইলেন। আইজ আমেনা বেগমের কাছে কী জবাব দিবো, সেইটাই ভাবতাছেন। এই মাছগুলা দিয়া আর যাই হোক, পেট ভরবো না। টিনের ঘর তুলনের স্বপ্নটা যেন আরো দূরের মনে হইতাছে।

এইদিকে রাশেদ মাতবরের বাড়িতে পৌঁছাইলো। মাতবরের বউ, মানে রাশেদের 'দাদি' বোয়াল মাছটা দেইখা খুব খুশি হইলো। "আহ, কি সুন্দর মাছ রে! ছত্তাটা আজ কপাল গুনে বড় মাছ পাইছে।" রাশেদরে হাতে একটা পাঁচ টেকার নোট ধরাইয়া দিলো সে। রাশেদ মুখ গোমড়া কইরা টেকাটা নিলো। তার বাপ যে মাছটা নিয়া এত কষ্ট করলো, সেইটা এমুন কইরা দিয়া দিতে তার ভালো লাগতাছিল না। সে জানে, এই বোয়াল মাছটা তাগো জন্য কতটা জরুরি ছিল।

বাড়িতে ফিরা রাশেদ দেখলো ছতু মিয়া উঠোনে চুপচাপ বইসা আছে। আমেনা বেগম আইসা জিগাইলো, "কী হইলো? মাছ কই?"

ছতু মিয়া লম্বা একটা শ্বাস ফালাইয়া সব খুইলা কইলেন। আমেনা বেগম প্রথমে কিছু কইলো না, শুধু নীরবে চোক্ষে জল ফেললো। অভাব তাগো নিত্যসঙ্গী, আর এই অভাব যেন মজিদ মাতবরের দয়ার উপর নির্ভরশীল।

"আর কতদিন এমুন কইরা চলবো গো?" আমেনা বেগম ফিসফিস কইরা কইলো। "পোলাপানগুলা বড় হইতাছে, তাগোও তো একটা ভবিষ্যত আছে।"

ছতু মিয়া কিছু কইতে পারলেন না। তার চোক্ষেও জল চিকচিক করতাছে। ছোটবেলায় তিনিও এমন মাতবরগো দাপট দেইখা বড় হইছেন। ভাবছিলেন নিজের পোলাপানগো অন্তত এই জীবন থেইকা মুক্তি দিবো। কিন্তু ভাগ্য যেন বারবার তাগো ঠেইলা দিতাছে একই বৃত্তে।

দিন গড়াইয়া যায়। ছতু মিয়ার পোলাপানগুলা যে যার মতোন কাজে লাইগা থাকে। কবিরা সবজি বেইচা, জহিরুল তারে সাহায্য করে। রাশেদ ইস্কুল থেইকা ফিরা যতটুকু পারে, বাঁশের টুকরা কাটতে বাপেরে সাহায্য করে। ছোট রফিকুলও মাঝে মাঝে বাঁশের কুচি নিয়া খেলার ছলে তাগো পাশে বইসা থাকে। আমেনা বেগমও তাগো কাজে উৎসাহ দেন, আর রান্নার ফাঁকে ফাঁকে বাঁশ শুকানোর কাজে হাত লাগান।

প্রথম দিকে কামটা সোজা ছিল না। বাঁশের জোগাড় পাইতে অনেক দূরে যাইতে হইতো, কখনও বা বেশি দাম দিয়া কিনতেও হইতো। তৈরি ঝুড়ি আর ডালি শহরে নিয়া যাওয়াটাও ছিল এক ঝক্কির ব্যাপার। কিন্তু ছতু মিয়া দইমা গেলেন না। তার চোক্ষে ভাসতো নতুন টিনের ঘরের স্বপ্ন, আর পোলাপানগো মুখে হাসি ফোটানোর আশা।

কয়েক মাস এমুন কইরা কাইটা গেল। ছতু মিয়া দেখলেন, বাঁশের কাজের আয় মাছ ধরার আয়ের থেইকা অনেক বেশি স্থিতিশীল। তাগো তৈরি ঝুড়ি আর ডালিগুলার মান ভালো হওয়ায়, শহরের ব্যাপারীরাও তাগো থেইকা নিয়মিত মাল নিতে শুরু করলো। অল্প অল্প কইরা টেকা জমতে লাগলো। সেই টেকা দিয়া ছতু মিয়া প্রথমে ঘরের ছাউনির জীর্ণ টিনগুলা পাল্টাইলেন। নতুন টিনগুলা লাগানোর পর বর্ষার দিনে ঘরে আর পানি পড়ে না। আমেনা বেগম পরম স্বস্তিতে লম্বা একটা শ্বাস ফালাইলেন।

তারপর আইলো সেই বহু প্রতীক্ষিত দিন। গ্রামের সবচেয়ে দক্ষ মিস্ত্রিকে ডাইকা আনা হইলো। ছতু মিয়ার স্বপ্ন পূরণ হইতে চলতাছে। তার বেড়ার ঘরের পাশেই শুরু হইলো নতুন টিনের ঘরের কাম। মাটি খুইড়া খুঁটি বসানো হইলো, বাঁশের ফ্রেম তৈরি হইলো, আর তারপর লাগানো হইলো ঝকঝকে নতুন টিন। গ্রামের লোক অবাক হইয়া দেখলো ছতু মিয়ার এই পরিবর্তন। মজিদ মাতবরও একদিন পাশ দিয়া যাইতে গিয়া থমকাইয়া খাড়াইলেন। ছতু মিয়ার কঠোর পরিশ্রম আর অদম্য জেদ দেইখা তিনিও হয়তো কিছুটা অবাক হইলো।

ঘরের কাম শেষ হইলো। যদিও এইটা মাতবরের মতো একতলা দালান নয়, কিন্তু ছতু মিয়া আর তার পরিবারের কাছে এইটা যেন এক রাজপ্রাসাদ। বাড়ির উঠোনে খাড়ায়া ছতু মিয়া তার নতুন ঘরের দিকে তাকাইয়া হাসলেন। রাশেদ, কবিরা, জহিরুল, রফিকুল আর ছোট্ট মাইয়াটিও আনন্দে আত্মহারা। আমেনা বেগমের চোক্ষে আনন্দের অশ্রু।

সেই রাইতে ছতু মিয়া উঠোনে বইসা আকাশের দিকে তাকাইলেন। জোনাকিরা আজও মিটিমিটি জ্বলতাছে। চান্দও তার ভরা আলো ছড়াইতাছে। কিন্তু আইজ তার মনে কোনো চাপা কষ্ট নাই, কোনো হাহাকার নাই। আইজ তার বুঁকে শুধু শান্তি আর তৃপ্তি। সেই বোয়াল মাছটা হয়তো তাগো ভাগ্য ঘুরাইয়া দেয় নাই, কিন্তু সেইটা শিখাইছিল যে, নিজের পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বাসই সবচেয়ে বড় শক্তি। অভাবের অন্ধকার কাইটা গেছে, জোনাকির আলোয় তাগো জীবনেও আইছে এক নতুন ভোর। ছতু মিয়া বুঝলেন, ছোট ছোট স্বপ্নগুলাই একদিন বড় সাফল্যে পরিণত হয়, শুধু দরকার অদম্য চেষ্টা আর বিশ্বাস।

নতুন টিনের ঘরে যখন প্রথম বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ শুনলেন ছতু মিয়া, তখন তার মনে হলো, এ যেন জীবনের সবচেয়ে মধুর সুর। আগে এই বৃষ্টির শব্দে বুক দুরুদুরু করতো, পানি পড়ার ভয়ে রাতের ঘুম হারাম হতো। আজ সেই বৃষ্টিই আনন্দের বার্তা নিয়ে এসেছে। আমেনা বেগম চুলায় চিতই পিঠা বানাচ্ছিলেন, আর পোলাপানগুলো নতুন ঘরের মেঝেতে মাদুর পেতে শুয়ে গল্প করছিলো। রফিকুল তার ছোট্ট বোনটার সাথে খুনসুটি করছিলো, আর কবিরা আর জহিরুল নতুন দিনের পরিকল্পনা করছিলো।

ছতু মিয়ার বাঁশের কাজের সুনাম এখন শুধু তাদের গ্রামেই নয়, পাশের কয়েকটা গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। শহরের বড় ব্যাপারীরাও ছতু মিয়ার নাম জানে। তিনি এখন আর শুধু বাঁশের ঝুড়ি-ডালি বানান না, আরও নানারকম বাঁশের জিনিস তৈরি করেন, যেমন – ফুলের টব, ছোট টুল, এমনকি বাঁশের তৈরি খেলনাও। তার হাতে এক অন্যরকম জাদু আছে যেন।

রাশেদও এখন স্কুলের পড়ালেখার পাশাপাশি বাবার কাজে পুরোপুরি সাহায্য করে। সে এখন আর আগের মতো ভীতু নেই। বরং তার চোখে-মুখে আত্মবিশ্বাসের ছাপ। সে বাবাকে নতুন নতুন নকশার আইডিয়া দেয়, আর ইন্টারনেট থেকে বাঁশের জিনিস তৈরির ভিডিও দেখে শিখে আসে। ছতু মিয়াও ছেলের আগ্রহ দেখে খুব খুশি হন। তার স্বপ্ন, রাশেদ একদিন এই কারিগরি বিদ্যাকে আরও আধুনিক করবে।

একদিন ছতু মিয়া সকালবেলা বাঁশের তৈরি কিছু জিনিসপত্র নিয়ে শহরে যাচ্ছিলেন বিক্রি করতে। পথে সেই মজিদ মাতবরের সাথে দেখা। মাতবর ছতু মিয়ার পরিবর্তন দেখে বেশ অবাক। তার জীর্ণ বেড়ার ঘরটা এখন ঝকঝকে টিনের ঘর হয়ে গেছে, আর ছতু মিয়ার মুখেও আগের সেই হতাশার ছাপ নেই।

মাতবর থমকে দাঁড়ালেন। "কিরে ছত্তা, আজকাল তোরে আর মাছ ধরতে দেহি না। কী করস আজকাল?"

ছতু মিয়া মৃদু হেসে বললেন, "আর কাকা, মাছ ধরার আয় দিয়া সংসার চলে না। এখন বাঁশের কাজ করি। আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই চলতাছে।"

মজিদ মাতবর বাঁশের তৈরি সুন্দর জিনিসগুলোর দিকে চেয়ে দেখলেন। তারপর একটা বাঁশের তৈরি ছোট টব হাতে নিয়ে বললেন, "আরে ছত্তা, তোর হাতের কাজ তো দেখছি বেশ ভালো! এইবার বুঝি তোর কপাল ফিরলো।"

ছতু মিয়া কিছু বললেন না, শুধু হাসলেন। তার মনে পড়লো সেই বোয়াল মাছের কথা, যে রাতে মাতবর তার মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছিলেন। সেদিন তিনি অসহায় ছিলেন, কিন্তু আজ আর নয়। তিনি শিখেছেন যে, নিজের পরিশ্রম আর মেধা থাকলে কেউ কারো ভাগ্য কেড়ে নিতে পারে না।

এখন ছতু মিয়ার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন হলো, তার ছোট মেয়েটাকে ভালো স্কুলে পড়ানো। সে চায় তার মেয়ে যেন বড় হয়ে শিক্ষিত হয়, কারো মুখাপেক্ষী না থাকে। আর ছেলেদের জন্য সে নতুন ব্যবসা শুরু করার চিন্তা করছে, যাতে তারা শুধু বাঁশের কাজ নয়, আরও অনেক কিছু করতে পারে।

জোনাকির আলোয় আবারও এক রাতের আকাশ ঝলমল করছে। ছতু মিয়া তার নতুন ঘরের বারান্দায় বসে আছেন। আজ আর তার কোনো ভয় নেই, কোনো চিন্তা নেই। অভাবের ঘোর অন্ধকার কেটে গেছে, তার জীবনে এখন শুধু আশার আলো। এই আলো তার পরিবারের মুখে হাসি ফুটিয়েছে, আর তাকে শিখিয়েছে জীবনের সবচেয়ে বড় পাঠ: নিজের প্রতি বিশ্বাস আর কঠোর পরিশ্রমই পারে ভাগ্যকে বদলে দিতে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.