অদৃশ্য বাঁধন: একটি পরকীয়া প্রেমের গল্প
সুমন আর লতার বিয়ে হয়েছে প্রায় পনেরো বছর। তাদের একটা ফুটফুটে মেয়ে আছে, অরুণিমা। সুমন একটি বেসরকারি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, আর লতা একটি নামকরা স্কুলের শিক্ষিকা। বাইরে থেকে তাদের জীবনটা সম্পূর্ণ সুখী ও গোছানো মনে হলেও, লতার মনে এক গভীর শূন্যতা বাসা বেঁধেছিল। সুমন কর্মব্যস্ততার অজুহাতে প্রায়শই লতাকে সময় দিতে পারতেন না। তাদের দাম্পত্য জীবনে আবেগ আর ভালোবাসার সেই জোয়ার অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছিল।
লতা ভালোবাসতেন পুরনো দিনের বাংলা গান শুনতে, বই পড়তে, আর প্রকৃতিকে নিজের মতো করে উপভোগ করতে। কিন্তু সুমনের জগৎ ছিল ফাইল, মিটিং আর অফিসের চাপ। তাদের রুচি আর ভালো লাগার ভিন্নতা সময়ের সাথে সাথে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। লতা অনুভব করতেন, তাদের সম্পর্কটা যেন অভ্যাসের বশে টিকে আছে, ভালোবাসার টানে নয়।
ঠিক তখনই তার জীবনে এলেন অর্ক। অর্ক ছিলেন তাদের স্কুলের নতুন আর্ট টিচার। বয়স সুমনের কাছাকাছি হলেও, অর্কের মধ্যে ছিল এক শিল্পীসুলভ মানসিকতা, যা লতাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করত। অর্ক ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছবি আঁকতে পারতেন, কবিতায় বুঁদ হয়ে থাকতে পারতেন, আর তার সাথে কথা বললে লতার মনে হতো তিনি যেন এক অন্য জগতে প্রবেশ করেছেন।
প্রথম দিকে তাদের সম্পর্কটা ছিল একান্তই পেশাদারী। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, আর্ট ওয়ার্কশপে তাদের একসাথে কাজ করতে হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য টান অনুভব করতে শুরু করলেন লতা। অর্ক লতার ভেতরের অনুভূতিগুলো বুঝতে পারতেন, তার মনের কথাগুলো যেন না বলতেই ধরে ফেলতেন। অর্কও লতার স্নিগ্ধতা আর বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ ছিলেন।
এক বিকেলে স্কুল ছুটি হওয়ার পর তারা দুজন স্কুলের করিডোরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। অর্ক লতাকে তার আঁকা কিছু স্কেচ দেখালেন, যার মধ্যে একটা ছিল একটি শান্ত নদীর ছবি। লতা যখন স্কেচটা দেখছিলেন, তখন অর্ক বললেন, "নদীটা খুব একা, তাই না? যেন কিছু একটা খুঁজছে।" লতা অবাক হয়ে অর্কের দিকে তাকালেন। অর্ক যেন তার মনের ভেতরের কথাটা বলে দিয়েছেন। সেই দিন থেকেই লতা অনুভব করলেন, অর্ক তার জন্য শুধুই একজন সহকর্মী নন, তার চেয়েও বেশি কিছু।
তাদের দেখা-সাক্ষাৎ বাড়তে লাগল। স্কুলের কাজে, মিটিংয়ে, বা ছুটির দিনে বইমেলায়। তাদের সম্পর্কটা ভালোবাসার মোড়কে ঢেকে যেতে শুরু করল। লতা প্রায়শই সুমনের কাছে নানা অজুহাত দিতেন অর্কের সাথে দেখা করার জন্য। এই লুকোচুরি খেলা তাকে এক নতুন ধরনের উত্তেজনা দিত, কিন্তু একই সাথে এক গভীর অপরাধবোধেও ভোগাত।
লতা জানতেন, তিনি ভুল করছেন। তার মেয়ে অরুণিমা আর সুমনের প্রতি তার দায়িত্বের কথা মনে পড়ত। কিন্তু অর্কের সান্নিধ্যে তিনি যে মানসিক শান্তি আর একাত্মতা অনুভব করতেন, তা থেকে নিজেকে দূরে রাখা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। অর্কও জানতেন লতা বিবাহিত, কিন্তু লতার প্রতি তার অনুভূতিগুলো তিনি দমন করতে পারতেন না। তাদের এই পরকীয়া সম্পর্কটা গভীর হতে শুরু করল।
লতা প্রায়ই অর্কের সাথে শহরের বাইরে কোনো নিরিবিলি জায়গায় যেত, যেখানে তাদের পরিচিত কেউ দেখতে পাবে না। গোপনীয়তা তাদের সম্পর্কের উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দিত। লতা তার সব না বলা কথা, সব স্বপ্ন অর্কের সাথে ভাগ করে নিতেন। অর্কও লতার প্রতি তার অনুভূতির গভীরতা প্রকাশ করতেন।
একদিন সুমন তার অফিসের কাজ থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরলেন। লতা তখন ফোনের রিংটোন শুনতে পাননি, অর্কের সাথে কথা বলছিলেন। সুমন লতার হাতে ফোনটা দেখে, আর তার আচরণে পরিবর্তন লক্ষ্য করে। লতার চোখে এক ধরনের অস্থিরতা আর ফোনটা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা সুমনের মনে সন্দেহ জাগিয়ে তোলে। সুমন লতার ফোনটা দেখতে চান, কিন্তু লতা ইতস্তত করেন।
সেই মুহূর্তে তাদের মধ্যে এক শীতল যুদ্ধ শুরু হয়। সুমন বুঝতে পারেন, লতা তাকে কিছু লুকাচ্ছেন। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর লতা আর ধরে রাখতে পারেননি। তিনি সুমনের কাছে তার সব ভুল স্বীকার করেন। সুমনের কাছে এটা ছিল এক চরম আঘাত। তার বিশ্বাস, তার পরিবার, তার সমস্ত স্বপ্ন যেন মুহূর্তেই ভেঙে খান খান হয়ে যায়।
লতা তার পরকীয়া থেকে বেরিয়ে এলেও, তাদের দাম্পত্য জীবনে এক বিশাল ক্ষত তৈরি হলো। সম্পর্কটা ভাঙনের মুখে এসে দাঁড়াল। হয়তো সমাজের চোখে লতার এই সম্পর্ক ছিল ভুল, কিন্তু তার মনের ভেতরের শূন্যতা তাকে এক অদৃশ্য বাঁধনে জড়িয়ে ফেলেছিল। এই গল্পে শেষ পর্যন্ত কেউ হয়তো সুখী হলো না, কিন্তু ভালোবাসার জটিল সমীকরণ আর মানুষের মনের অপ্রাপ্তিগুলো যেন আরও একবার সামনে এসে দাঁড়াল।
গল্পটি আপনার কেমন লেগেছে?