ভাঙা আয়না, প্রতিবিম্বের খেলা
শোভন আর অনন্যা, দশ বছরের দাম্পত্য তাদের। দুটি ফুটফুটে ছেলেমেয়ে, একটি সাজানো গোছানো ফ্ল্যাট, আর সমাজের চোখে এক সুখী পরিবার। শোভন একজন স্থপতি, আর অনন্যা একজন চিত্রশিল্পী। তাদের শিল্পরুচি আর সংবেদনশীল মন তাদের সম্পর্ককে একসময় বেশ গভীরতা দিয়েছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই গভীরতা ম্লান হতে শুরু করেছিল। শোভন তার কাজে এতটাই ডুবে যেত যে অনন্যা নিজেকে তার জীবনে এক অদৃশ্য প্রাচীরের ওপারে আবিষ্কার করত। তাদের আলোচনাগুলো কেবল সংসার আর সন্তান কেন্দ্রিক হয়ে যেত, যেখানে ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলোর কোনো স্থান ছিল না। অনন্যার তুলির রঙও যেন ফিকে হয়ে আসছিল।
এই শূন্যতার মাঝেই অনন্যার জীবনে এলো অর্জুন। অর্জুন ছিল তার আর্ট গ্যালারির নিয়মিত দর্শক, একজন সঙ্গীতজ্ঞ। অর্জুন যখন অনন্যার আঁকা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলত, তখন অনন্যা অনুভব করত যেন তার ভেতরের ভাষাগুলো অর্জুন বুঝতে পারছে। অর্জুনের চোখের গভীরতা, তার কথার সুর, আর তার শিল্পসত্ত্বা অনন্যাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করত। অর্জুনও অনন্যার ছবিতে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা আর গভীরতা খুঁজে পেত, যা তাকে অনন্যার প্রতি টানত।
প্রথম দিকে তাদের সম্পর্ক ছিল শুধু শিল্প আর সঙ্গীতের আদান-প্রদান। গ্যালারিতে তাদের দেখা হতো, শিল্পের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হতো। অনন্যা অবাক হতো, অর্জুন কিভাবে তার আঁকা ছবির পেছনের গল্পগুলো না বলতেই বুঝে ফেলত। ধীরে ধীরে তাদের এই পেশাদারী সম্পর্ক ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতায় রূপ নিতে শুরু করল। শোভনের অনুপস্থিতি আর অনন্যার ভেতরের শূন্যতা তাদের সম্পর্ককে আরও গভীর করে তুলল।
তারা প্রায়ই গ্যালারির কাজের অজুহাতে শহরের কোনো নিরিবিলি কফি শপে দেখা করত। অর্জুন তার নিজের কম্পোজ করা গান শোনাত, আর অনন্যা মুগ্ধ হয়ে শুনত। অর্জুনের গানের কথাগুলো যেন অনন্যার নিজেরই মনের কথা। এই গোপন সম্পর্ক অনন্যাকে এক নতুন ধরনের আত্মবিশ্বাস দিচ্ছিল, যা সে শোভনের কাছে অনেকদিন পায়নি। কিন্তু একই সাথে এক গভীর অপরাধবোধ তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। সে জানত, সে তার পরিবার, তার সন্তানদের সাথে অবিচার করছে। কিন্তু অর্জুনের সান্নিধ্য তাকে এমন এক শান্তি দিত, যা থেকে বেরিয়ে আসা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠছিল।
একদিন অর্জুন অনন্যাকে তার স্টুডিওতে আমন্ত্রণ জানাল। স্টুডিওটা ছিল শহরের এক কোণে, খুব নিরিবিলি জায়গায়। সেখানে বসে অর্জুন পিয়ানো বাজাচ্ছিল, আর অনন্যা তার পাশে বসে শুনছিল। পিয়ানোর সুর যেন তাদের ভেতরের সব না বলা কথাগুলো প্রকাশ করছিল। সেই মুহূর্তে তাদের মধ্যে এক নীরব চুক্তি হলো। তারা একে অপরের প্রতি তাদের গভীর অনুভূতির কথা স্বীকার করল, যদিও মুখে কোনো শব্দ উচ্চারণ হয়নি। তাদের সম্পর্ক এক নতুন, নিষিদ্ধ অধ্যায়ে প্রবেশ করল।
অনন্যা আর অর্জুনের দেখা-সাক্ষাৎ আরও ঘন ঘন হতে লাগল। তারা একে অপরের কাছে তাদের মনের সব গোপন কথা খুলে বলত, তাদের স্বপ্ন, তাদের হতাশা – সবকিছু। এই গোপন সম্পর্ক তাদের জন্য ছিল এক অদৃশ্য আশ্রয়, যেখানে তারা নিজেদের মতো করে বাঁচতে পারত। কিন্তু এই সুখের আড়ালে ছিল এক constant ভয়। কখন তাদের এই গোপন অধ্যায় সকলের সামনে চলে আসে, সেই আতঙ্ক তাদের তাড়া করত।
একদিন, অনন্যার ছোট ছেলে অনিশার জন্মদিন ছিল। শোভন যথারীতি দেরিতে অফিস থেকে ফিরল, ক্লান্ত আর বিরক্ত। অনন্যা অনুভব করল, শোভনের সাথে তার দূরত্ব আরও বেড়ে গেছে। সেই রাতে, অনিশাকে ঘুম পাড়ানোর পর অনন্যা নিজের ঘরে একা বসে ছিল। তার ফোন বেজে উঠল, অর্জুন। অর্জুন তাকে শুভরাত্রি বলার জন্য ফোন করেছিল। অনন্যা ফোনটা রিসিভ করল, আর ফিসফিস করে কথা বলতে লাগল।
হঠাৎ করে শোভন ঘরে ঢুকল। অনন্যা চমকে উঠল, ফোনটা রেখে দিল। শোভন অনন্যার চোখে এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করল। তার চেহারা দেখে শোভনের মনে সন্দেহ দানা বাঁধল। শোভন সরাসরি কিছু না বললেও, তার নীরব চাহনি যেন অনন্যাকে হাজার প্রশ্ন করছিল। সেই রাতে তাদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি, শুধু এক নীরব দেয়াল তাদের আলাদা করে রেখেছিল।
পরের দিনগুলোতে শোভন অনন্যাকে লক্ষ্য করতে লাগল। তার ফোনের ব্যবহার, তার বাইরের গতিবিধি – সবকিছু। একদিন শোভন অনন্যার ফোনের মেসেজ দেখতে পেল, অর্জুনের সাথে তার কিছু গভীর কথাবার্তা। শোভনের পৃথিবী যেন থমকে গেল। তার বিশ্বাস, তার সাজানো সংসার – সবকিছু যেন এক মুহূর্তে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
শোভন আর অনন্যার দাম্পত্য জীবন এক চরম পরীক্ষার মুখে পড়ল। অর্জুনের সাথে অনন্যার সম্পর্ক শেষ হলেও, তার রেশ রয়ে গেল তাদের পরিবারে। ভাঙা আয়নার মতো তাদের সম্পর্ক, যেখানে প্রতিবিম্বগুলো অস্পষ্ট, আর বিশ্বাসগুলো ভেঙে গেছে। ভালোবাসার এই জটিল খেলায় শেষ পর্যন্ত কে জিতল, তা বলা মুশকিল। তবে এই গল্প প্রমাণ করে, মানুষের মনের অপ্রাপ্তি আর আবেগের টানাপোড়েন কিভাবে একটি সুখী সংসারকে ভেঙে দিতে পারে, আর কিভাবে এক অদৃশ্য টান এক নতুন পথের দিকে নিয়ে যায়, যা হয়তো শেষ পর্যন্ত শুধু যন্ত্রণা আর অনুশোচনাই বয়ে আনে।