অদম্য দীপন: মায়ের চোখের আলো ফেরাতে

অদম্য দীপন: মায়ের চোখের আলো ফেরাতে


দীপন ও পারুল বেগমের আটপৌরে জীবন
বাংলাদেশের এক নিভৃত পল্লীর ছোট্ট একটি ঘরে দীপন আর তার মা পারুল বেগমের সংসার। গ্রামের আর দশটা পরিবারের মতোই তাদের জীবন ছিল সাদামাটা, আটপৌরে। তবে, এই সাদামাটা জীবনেই লুকিয়ে ছিল এক গভীর, অটুট ভালোবাসা, যা তাদের প্রতিটি দিনকে অর্থপূর্ণ করে তুলত। দীপনের বয়স তখন সতেরো পেরিয়ে আঠারোর কোঠায়। সদ্যই সে কলেজে পা রেখেছে। তার চোখে স্বপ্ন, মনে অদম্য জেদ। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই সে ছিল পারুল বেগমের একমাত্র অবলম্বন, তার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ।
দীপনের বাবা ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক। হঠাৎ এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তিনি যখন মারা গেলেন, তখন দীপন ছিল নিতান্তই ছোট। সেই সময় থেকেই পারুল বেগম নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে দীপনকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। তিনি জানতেন, তার এই ছোট সন্তানই তার ভবিষ্যৎ, তার পৃথিবীর সব আশা। দিনের পর দিন তিনি মাঠে কাজ করেছেন, অন্যের বাড়িতে ধান ভেনেছেন, এমনকি কাঁথা সেলাই করে বাজারে বিক্রি করেছেন—সবই শুধু দীপনকে একটু ভালো রাখার জন্য, তাকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলার জন্য। পারুল বেগমের কপালে স্থায়ী হওয়া রেখাগুলো, তার হাতে জেগে ওঠা শিরাগুলো যেন তার ত্যাগের নীরব সাক্ষী ছিল। তিনি কখনো নিজের কথা ভাবেননি, নিজের কষ্টের কথা বলেননি। তার কাছে দীপনের হাসিই ছিল সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, দীপনের মঙ্গলই ছিল তার জীবনের একমাত্র প্রার্থনা।
দীপনও মাকে প্রচণ্ড ভালোবাসত। মায়ের কষ্ট সে খুব কাছ থেকে দেখত। মায়ের মলিন শাড়ির আঁচলে লেগে থাকা ধুলো, শীতের রাতে কনকনে ঠান্ডায় মায়ের হাত-পায়ের জমে যাওয়া ছোপ ছোপ কালশিটে দাগ—এসব কিছুই দীপনের মনে এক গভীর ছাপ ফেলেছিল। সে ছোটবেলা থেকেই প্রতিজ্ঞা করেছিল, বড় হয়ে সে মায়ের সব দুঃখ দূর করবে। মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে। তার কলেজের বই, ছেঁড়া স্যান্ডেল, পুরনো সাইকেল—সবকিছুই ছিল তার মায়ের পরিশ্রমের ফল। তাই সে পড়াশোনায় ছিল অত্যন্ত মনোযোগী। ক্লাসের সেরা ছাত্রদের মধ্যে সে ছিল একজন। তার স্বপ্ন ছিল, একদিন সে শহরের কোনো বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, আর তারপর একটা ভালো চাকরি করে মায়ের জন্য একটি সুন্দর বাড়ি বানাবে। সেই বাড়িতে থাকবে মায়ের পছন্দের গোলাপ গাছ, আর শীতের সকালে মাকে দেখিয়ে দেবে কুয়াশা ঢাকা দিগন্ত।
তাদের ছোট ঘরটি ছিল ভালোবাসার উষ্ণতায় ভরা। সকালে মায়ের হাতে গরম ভাতের গন্ধ, দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে মায়ের অপেক্ষায় থাকার আনন্দ, আর রাতে হারিকেনের আবছা আলোয় মায়ের পাশে বসে গল্প শুনতে শুনতে পড়াশোনা করা—এইসব ছোট ছোট মুহূর্তগুলো দিয়েই গড়ে উঠেছিল তাদের জীবন। পারুল বেগম যখন দীপনের পছন্দের লাউ শাক ভাজি করতেন, তখন দীপনের মুখে যে তৃপ্তির হাসি ফুটত, পারুল বেগমের কাছে সেই হাসিই ছিল পৃথিবীর সেরা সম্পদ। অভাব ছিল, কিন্তু তাদের জীবনে ভালোবাসার কোনো অভাব ছিল না। এই অটুট বন্ধনই তাদের কঠিন জীবনযাত্রাকে সহজ করে তুলেছিল।

মায়ের চোখের ছানি: অন্ধকার নেমে আসার পূর্বাভাস
পারুল বেগম, দীপনের কাছে যার চোখ দুটি ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আয়না, সেই চোখেই একদিন বিপদের কালো মেঘ জমতে শুরু করল। প্রথম দিকে ছোটখাটো সমস্যা। পড়তে গিয়ে অক্ষরের ঝাপসা লাগা, সূঁচ সুতোয় ঢোকাতে কষ্ট হওয়া, বা অন্ধকারে হোঁচট খাওয়া—এগুলো ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। পারুল বেগম প্রথমে এগুলোকে বয়সের লক্ষণ ভেবে তেমন একটা পাত্তা দেননি। গ্রামের অনেকেই বলত, "বয়স হলে চোখ একটু কম দেখে, এটা স্বাভাবিক।" কিন্তু দীপনের মন খুতখুত করত। মায়ের চোখে সে আগের মতো উজ্জ্বলতা দেখতে পেত না।
একদিন বিকেলে দীপন কলেজ থেকে ফিরে দেখল, মা রান্নাঘরে কিছু একটা খুঁজতে গিয়ে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। চুলায় ভাত পুড়ে গেছে। পারুল বেগম লজ্জিত মুখে বললেন, "আলোটা কেমন যেন কম লাগছে, বাবা। চোখে আর আগের মতো জোর পাই না।" দীপনের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। মায়ের কণ্ঠে এক ধরনের অসহায়ত্ব ছিল যা সে আগে কখনো শোনেনি। সে বুঝতে পারল, এটা কোনো সাধারণ চোখের সমস্যা নয়।
পরের কয়েক সপ্তাহে পারুল বেগমের দৃষ্টিশক্তি দ্রুত কমতে শুরু করল। দিনে দুপুরেও তিনি ঘরের জিনিসপত্র ঠিকমতো দেখতে পেতেন না। দীপনকে চিনতে পারতেন তার গলার আওয়াজ শুনে, স্পর্শ করে। রান্না করা, হাঁটাচলা করা—সবকিছুই তার জন্য কঠিন হয়ে উঠল। এক পর্যায়ে তিনি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়লেন যে, ঘরের ভেতরেও চলাফেরা করতে তার ভীষণ কষ্ট হতো। রাতের বেলা তার অবস্থা আরও খারাপ হতো। একসময় তার চোখের সামনে সবকিছুই ঝাপসা, অস্পষ্ট মনে হতে লাগল। দীপনের মনে হলো, মায়ের চোখের উজ্জ্বলতা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তার মায়ের দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে।
দীপন আর দেরি করল না। গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারদের দেখিয়ে কোনো লাভ হয়নি, তারা শুধু চোখ পরিষ্কার রাখতে আর কিছু আয়ুর্বেদিক ওষুধ দিতে পারতেন। তাই সে মায়ের হাত ধরে শহরের দিকে রওনা দিল। তার হাতে যৎসামান্য কিছু টাকা, যা সে টিউশনি করে আর কয়েকটা বাড়তি কাজ করে জমিয়েছিল। শহরের বড় বাসস্ট্যান্ডে এসে মায়ের হাত ধরে সাবধানে ভিড় ঠেলে তারা একটি পুরনো চক্ষু হাসপাতালের দিকে এগিয়ে গেল। পারুল বেগমের চোখ দুটি তখন এতটাই অস্পষ্ট দেখছিল যে, তিনি দীপনের হাত শক্ত করে ধরে রাখছিলেন, যেন একমাত্র সেই তার পথপ্রদর্শক।
৩. রোগ নির্ণয়: কঠিন সত্যের মুখোমুখি
চক্ষু হাসপাতালে পৌঁছে তাদের অপেক্ষা করতে হলো দীর্ঘ সময়। দীপন মাকে একটি বেঞ্চে বসিয়ে রেখে ভর্তির কাগজপত্র তৈরি করল। তার চোখেমুখে ছিল উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তা। অবশেষে ডাক্তারের ডাক পড়ল। একজন অভিজ্ঞ চক্ষু বিশেষজ্ঞ পারুল বেগমকে পরীক্ষা করলেন। তিনি বিভিন্ন যন্ত্র দিয়ে পারুল বেগমের চোখ পরীক্ষা করলেন, লেন্স দেখলেন, চোখের ভেতরে আলো ফেললেন। দীপন রুদ্ধশ্বাসে ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।
পরীক্ষা শেষে ডাক্তার গম্ভীর মুখে দীপনকে পাশের ঘরে ডাকলেন। তিনি বললেন, "আপনার মায়ের চোখে গুরুতর ছানি (Cataract) পড়েছে। ছানি এতটাই ঘন হয়ে গেছে যে, তার লেন্স প্রায় সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় তিনি প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না।" ডাক্তারের এই কথা শুনে দীপনের পৃথিবী যেন থেমে গেল। ছানি রোগের নাম সে শুনেছে, কিন্তু এতটা গুরুতর হতে পারে তা সে ভাবেনি।
ডাক্তার আরও ব্যাখ্যা করলেন, "এই ছানি যদি জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচার করে অপসারণ না করা হয়, তাহলে আপনার মা চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারাবেন। দ্রুত অস্ত্রোপচার করা অত্যন্ত জরুরি।" এরপর ডাক্তার অস্ত্রোপচারের খরচ সম্পর্কে বললেন, যা ছিল দীপনের সাধ্যের বাইরে। এটি শুধু একটি ছানি অপসারণ ছিল না, এটি ছিল একটি জটিল প্রক্রিয়া যেখানে বিশেষ লেন্স প্রতিস্থাপন করতে হবে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
টাকার অঙ্কটা শুনে দীপনের মাথা ঘুরতে লাগল। তার সমস্ত স্বপ্ন, সমস্ত পরিকল্পনা যেন চোখের পলকে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। মায়ের চোখের আলো নিভে যাচ্ছে, আর সে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে! কীভাবে এত টাকা জোগাড় করবে? এই বিশাল অঙ্কের কথা শুনে পারুল বেগমও হতাশ হয়ে পড়লেন। তিনি দীপনের দিকে তাকিয়ে বললেন, " থাক বাবা, এত টাকা খরচ করিস না। আমার নিয়তি এটাই।" মায়ের এই কথা দীপনের বুকে তীরের মতো বিঁধল। সে কিছুতেই মাকে অন্ধ হতে দেবে না। সে ডাক্তারকে আশ্বস্ত করল, "আমি টাকা জোগাড় করব স্যার, যেভাবেই হোক জোগাড় করব। আপনি শুধু আমার মায়ের চোখের আলো ফিরিয়ে দিন।"
সেই মুহূর্তে দীপনের মনে এক তীব্র সংকল্প জন্ম নিল। তার মাকে পৃথিবীর সৌন্দর্য আবার দেখাতে হবে। তার মায়ের হাসি আবার সেই পুরনো উজ্জ্বলতায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এই কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও দীপন দমে গেল না। তার মনে তখন একটাই চিন্তা—যে কোনো মূল্যে, যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করে সে মায়ের চোখের আলো ফিরিয়ে আনবেই।

অর্থ জোগাড়ের মরিয়া চেষ্টা: যখন সব পথ বন্ধ মনে হয়
ডাক্তারের কাছ থেকে মায়ের চোখের ছানি এবং তার জরুরি অস্ত্রোপচারের কথা শোনার পর দীপনের মনে এক অস্থিরতা শুরু হলো। টাকার অঙ্কটা তার কাছে ছিল আকাশছোঁয়া। তার টিউশনির সামান্য আয় আর টুকটাক কাজ করে যা জমানো ছিল, তা এই বিশাল খরচের কাছে কিছুই না। কিন্তু মায়ের চোখের আলো নিভে যাচ্ছে, আর সে অসহায়ভাবে চেয়ে থাকবে – এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে দীপন মাকে নিয়ে গ্রামের পথে ফিরল। পারুল বেগম তখনো জানতেন না যে, তার ছেলের মনে কী ঝড় বইছে। তিনি শুধু জানতেন, তার চোখে সমস্যা হয়েছে এবং তার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা লাগবে। মা যখন বাড়িতে ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, দীপন তখন পাগলের মতো টাকা জোগাড়ের উপায় খুঁজতে লাগল।
প্রথমেই সে তার পরিচিত সব আত্মীয়-স্বজনদের কাছে গেল। দূর সম্পর্কের চাচা, ফুফু, মামা – যারাই একটু স্বচ্ছল ছিলেন, সবার দরজায় সে কড়া নাড়ল। সে তাদের কাছে মায়ের অসুস্থতার কথা খুলে বলল, চোখের অস্ত্রোপচারের গুরুত্ব বোঝাল। কিন্তু সবার কাছ থেকেই সে প্রায় একই উত্তর পেল – "আমাদের নিজেদেরই টানাটানি চলছে, বাবা। এত টাকা আমরা কোত্থেকে দেব?" কেউ কেউ সামান্য কিছু টাকা দিয়ে সহানুভূতি দেখালেন, যা সমুদ্রে এক ফোঁটা জলের মতো। দীপনের মনে হলো, বিপদের সময় মানুষ কত অসহায় হয়ে পড়ে।
এরপর সে তার কলেজের বন্ধুদের কাছে গেল। তারা সবাই দীপনের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। তারা সহানুভূতি দেখালেও, এত বড় অঙ্কের টাকা জোগাড় করার ক্ষমতা তাদেরও ছিল না। দীপন শহরের বিভিন্ন দোকানে কাজের খোঁজে ঘুরল। সে দিনমজুরের কাজ করতেও রাজি ছিল, যদি তাতে দ্রুত কিছু টাকা আসে। কিন্তু তার মতো অল্প বয়সী, অনভিজ্ঞ ছেলেকে কেউ বড় অঙ্কের মজুরিতে কাজ দিতে চাইল না। কিছু দোকানে সে পার্ট-টাইম কাজের সুযোগ পেল, কিন্তু তাতে মায়ের চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে কয়েক বছর লেগে যাবে, আর ততদিনে হয়তো মায়ের চোখ চিরতরে অন্ধ হয়ে যাবে।
প্রতিদিন রাতে দীপন যখন মায়ের পাশে শুয়ে থাকত, তখন তার মনে এক অসহ্য যন্ত্রণা হতো। মায়ের ঝাপসা দৃষ্টি, অন্ধকারে হাতড়ে চলা – এসব দেখে তার বুক ফেটে যেত। সে নিজেকে বারবার জিজ্ঞেস করত, "আমি কি কিছুই করতে পারব না? আমার মাকে কি অন্ধ হয়েই বাকি জীবন কাটাতে হবে?" তার চোখের কোণে জল জমে উঠত, কিন্তু সে মাকে বুঝতে দিত না। সে জানত, সে ভেঙে পড়লে মা আরও বেশি কষ্ট পাবেন।
এক রাতে, যখন সবাই ঘুমিয়ে ছিল, দীপন চুপচাপ বিছানা ছেড়ে উঠল। সে ঘরের হারিকেনের মৃদু আলোয় বসে ভাবতে লাগল। তার মাথায় তখন কেবল একটাই চিন্তা – কীভাবে দ্রুত টাকা জোগাড় করা যায়? সব পথ যখন বন্ধ মনে হচ্ছিল, তখন তার মনে একটি ভয়ংকর কিন্তু অত্যন্ত সাহসী চিন্তার উদয় হলো। সে শুনেছিল, শহরে কিছু হাসপাতালে কিডনি বিক্রি করা যায়। প্রথমে তার শরীর শিউরে উঠল। নিজের শরীরের একটি অংশ বিক্রি করা! এটা কি সম্ভব? কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকাতেই তার সব দ্বিধা দূর হয়ে গেল। মায়ের চোখের আলো যদি ফিরে আসে, তাহলে তার নিজের কষ্ট কোনো ব্যাপার নয়।
৫. আত্মত্যাগের কঠিন সিদ্ধান্ত: কিডনি বিক্রির পথ
পরের দিন সকালে, দীপন তার মাকে কিছু না জানিয়েই শহরের দিকে রওনা দিল। সে মাকে বলেছিল, সে নাকি শহরে একটা নতুন কাজের সুযোগ পেয়েছে, যা থেকে মায়ের চিকিৎসার খরচ জোগাড় হবে। পারুল বেগম সরল মনে ছেলের কথা বিশ্বাস করলেন, ছেলের চোখে এক নতুন আশার ঝলক দেখে তিনি স্বস্তি পেলেন।
শহরে পৌঁছে দীপন সরাসরি একটি বড় বেসরকারি হাসপাতালের দিকে গেল, যেখানে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় বলে সে শুনেছিল। হাসপাতালের অভ্যর্থনা কক্ষে গিয়ে সে ইতস্তত করে তার ইচ্ছার কথা জানাল – সে তার একটি কিডনি বিক্রি করতে চায়। অভ্যর্থনাকারী প্রথমে অবাক হলেন, তারপর তাকে একজন সমাজকর্মীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
সমাজকর্মী দীপনের সাথে বিস্তারিত কথা বললেন। তিনি দীপনের বয়স, তার পরিবারের অবস্থা, এবং কেন সে কিডনি বিক্রি করতে চাইছে – এসব জানতে চাইলেন। দীপন তার মায়ের অন্ধত্বের কথা সবিস্তারে বলল, তার অসহায়ত্বের কথা জানাল। সে বোঝাল, তার মায়ের চোখের আলো ফিরিয়ে আনা তার জীবনের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য। সমাজকর্মী দীপনের কথা শুনে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। তিনি দীপনের দৃঢ় সংকল্প এবং মায়ের প্রতি তার ভালোবাসার গভীরতা বুঝতে পারলেন।
তবে, কিডনি বিক্রি করা একটি সহজ প্রক্রিয়া ছিল না। আইনগতভাবে এর অনেক জটিলতা ছিল। সমাজকর্মী দীপনকে সব নিয়মকানুন এবং ঝুঁকির বিষয়ে বিস্তারিত বোঝালেন। তিনি বললেন, "তুমি একজন সুস্থ মানুষ। তোমার একটি কিডনি চলে গেলে তোমার নিজের জীবনেও অনেক ঝুঁকি থাকতে পারে। ভবিষ্যতে তোমার স্বাস্থ্যগত সমস্যা হতে পারে।" কিন্তু দীপন ছিল অটল। সে বলল, "আমার মায়ের চোখের আলোর কাছে এই ঝুঁকি কিছুই না। আমি সবকিছুর জন্য প্রস্তুত।"
দীপনের এই অদম্য জেদ এবং মায়ের প্রতি তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেখে সমাজকর্মী এবং হাসপাতালের ডাক্তাররা শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। তারা দীপনের শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন। রক্ত পরীক্ষা, টিস্যু ম্যাচিং, বিভিন্ন অঙ্গের কার্যকারিতা পরীক্ষা – সব ধরনের পরীক্ষা করা হলো, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে দীপন একজন উপযুক্ত দাতা এবং তার কিডনি বিক্রির পর তার নিজের স্বাস্থ্যের বড় কোনো ক্ষতি হবে না।
এই পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল দীপনের জন্য মানসিক এবং শারীরিক উভয় দিক থেকেই অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু মায়ের মুখ মনে পড়লেই তার সব কষ্ট ফিকে হয়ে যেত। সে জানত, এই ত্যাগ বৃথা যাবে না। তার এই আত্মত্যাগই তার মায়ের চোখে আবার আলো ফিরিয়ে আনবে, আর সেই আলোয় সে দেখতে পাবে তার নিজের জীবনের সার্থকতা।

অস্ত্রোপচার: ত্যাগের চূড়ান্ত মুহূর্ত
দীপনের কিডনি বিক্রির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কিছুদিন সময় লাগল। সমস্ত শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হওয়ার পর এবং আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অস্ত্রোপচারের তারিখ ঠিক করা হলো। দীপন তার মাকে এই বিষয়ে কিছুই জানায়নি। পারুল বেগম জানতেন না যে, তার চোখের আলোর জন্য তার সন্তান তার নিজের শরীরের একটি অংশ উৎসর্গ করতে চলেছে। দীপন মাকে শুধু বলেছিল যে, সে শহরে একটা ভালো কাজ পেয়েছে এবং সেই কাজের পারিশ্রমিক দিয়েই মায়ের চোখের চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে। পারুল বেগমের চোখেমুখে তখন এক নতুন আশার আলো।
অস্ত্রোপচারের দিন সকালে দীপনের মনে এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল। একদিকে অপারেশনের ভয়, নিজের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হারানোর অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে মায়ের চোখে আবার আলো ফেরার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। সে জানত, এই কষ্ট ক্ষণিকের, কিন্তু মায়ের খুশি হবে চিরন্তন। যখন তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তার মনে তখন শুধু মায়ের হাসিমুখ ভেসে উঠছিল। সে মনে মনে প্রার্থনা করছিল, যেন সবকিছু নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়।
প্রায় পাঁচ ঘণ্টার দীর্ঘ এবং জটিল অস্ত্রোপচার সফল হলো। দীপনের একটি কিডনি সুস্থভাবে বের করে নেওয়া হলো এবং নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে প্রতিস্থাপন করা হলো। ডাক্তাররা দীপনকে রিকভারি রুমে নিয়ে গেলেন। জ্ঞান ফেরার পর দীপনের শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব হলো, কিন্তু তার মনে ছিল এক অদ্ভুত শান্তি। সে জানত, তার এই ত্যাগ সফল হয়েছে।
অন্যদিকে, পারুল বেগমের চোখের অস্ত্রোপচারও একই হাসপাতালে সম্পন্ন হলো। দীপন সফল অস্ত্রোপচারের পর কিছুটা সুস্থ হতেই মাকে দেখতে চাইল। যখন তাকে মায়ের কেবিনে নিয়ে যাওয়া হলো, পারুল বেগম তখনো পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে পাননি। দীপন দেখল, মায়ের চোখের ওপর ব্যান্ডেজ বাঁধা। তার মনে হলো, মায়ের কষ্ট যেন তার নিজের কষ্টকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সে মায়ের হাত ধরে নীরবে বসে রইল, তার চোখে ছিল এক ভিন্ন রকম কৃতজ্ঞতা।
৭. আরোগ্যলাভ এবং মা-ছেলের নতুন বন্ধন
অস্ত্রোপচারের পরের দিনগুলো ছিল ধীরে ধীরে আরোগ্যলাভের। দীপনকে কিছুদিনের জন্য হাসপাতালে থাকতে হলো নিবিড় পর্যবেক্ষণে। তার শরীরে দুর্বলতা ছিল, কিন্তু সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছিল। হাসপাতালের নার্সরা তার যত্ন নিতেন, আর ডাক্তাররা তার শারীরিক অবস্থা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতেন। দীপন জানত, এই কষ্ট সাময়িক, তার মায়ের চোখ ভালো হলেই তার সব ব্যথা দূর হয়ে যাবে।
কয়েক দিন পর পারুল বেগমের চোখের ব্যান্ডেজ খোলা হলো। যখন তিনি প্রথমবার চোখ খুলে স্পষ্ট দেখতে পেলেন, তখন তার চোখে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। রুমের সবকিছু, ডাক্তার, নার্স – সবকিছুই তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন। আর সবার আগে যাকে তিনি স্পষ্ট দেখলেন, সে ছিল তার দীপন। পারুল বেগম দীপনকে কাছে টেনে নিলেন, তার চোখে ছিল এক গভীর আবেগ। তিনি তার সন্তানকে স্পষ্ট দেখতে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে গেলেন।
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর পারুল বেগম সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন। কিন্তু একদিন তিনি দীপনের হাতে একটি নতুন কাটা দাগ দেখতে পেলেন। দাগটি দেখে তার মনে সন্দেহ হলো। তিনি দীপনকে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, "তোর হাতে এটা কিসের দাগ, বাবা? তুই অসুস্থ ছিলি নাকি?" দীপন প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইল, মাকে চিন্তা করাতে চাইল না। কিন্তু মায়ের ক্রমাগত পীড়াপীড়িতে সে শেষ পর্যন্ত সত্যিটা বলতে বাধ্য হলো।
যখন দীপন তার মায়ের চোখের আলোর জন্য নিজের একটি কিডনি বিক্রি করার কথা বলল, পারুল বেগম বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। তার চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরতে লাগল। এই অশ্রু দুঃখের ছিল না, ছিল গভীর ভালোবাসা, গর্ব, আর নিজের সন্তানের প্রতি অসীম মুগ্ধতার। তিনি তার ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তিনি ফিসফিস করে বললেন, "আমার সোনা, তুই আমার জন্য কী করলি! তুই আমার চোখের আলো ফিরিয়েছিস, কিন্তু তোর এই আত্মত্যাগ আমি জীবনেও ভুলব না। আল্লাহ তোকে দীর্ঘজীবী করুন।"
দীপন মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। সে বলল, "মা, তোমার হাসিই আমার কাছে সব। তুমি যদি ভালো থাকো, তাহলে আমার সব কষ্ট সার্থক।" সেই দিন থেকে পারুল বেগম দীপনকে শুধু সন্তান হিসেবে দেখতেন না, দেখতেন তার জীবনের ত্রাণকর্তা হিসেবে, তার আত্মার অংশ হিসেবে। দীপনও মায়ের প্রতি আরও বেশি যত্নশীল হয়ে উঠল। সে নিজের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখত, কারণ তার মা এখন তার ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল ছিলেন।
৮. উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এবং আত্মত্যাগের স্মৃতি
দীপন আবার কলেজে ফিরল, এবার তার পড়াশোনায় আরও বেশি মনোযোগ ছিল। সে জানত, মায়ের আত্মত্যাগ তাকে নতুন জীবন দিয়েছে, আর সে তার মায়ের এই ত্যাগের সম্মান রাখবে। সে পড়াশোনায় আরও ভালো ফল করতে লাগল, তার স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে চলল। দীপন এখন কেবল নিজের জন্য স্বপ্ন দেখত না, মায়ের জন্য দেখত। সে মায়ের জন্য একটি সুন্দর বাড়ি বানানোর শপথ নিল, যেখানে পারুল বেগম নির্ভয়ে হেঁটে বেড়াতে পারবেন, ফুল গাছ লাগাতে পারবেন, আর আলোকিত পৃথিবীতে তার দীপনকে সফল হতে দেখতে পারবেন।
পারুল বেগমও দীপনের প্রতিটি সাফল্যে গর্বিত হতেন। তিনি তার ছেলেকে নিয়ে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন, আর সবার কাছে বলতেন, "আমার দীপন আমার চোখের আলো ফিরিয়ে এনেছে।" গ্রামের মানুষেরা দীপনকে শ্রদ্ধা করত, তার আত্মত্যাগের গল্প সবার মুখে মুখে ফিরত। দীপন প্রমাণ করেছিল যে, ভালোবাসা এবং ত্যাগের কোনো মূল্য হয় না, এর শক্তি অসীম।

"অদম্য দীপন" গল্পটি কেবল একটি ছেলের আত্মত্যাগের গল্প ছিল না, এটি ছিল মা-ছেলের সম্পর্কের এক গভীর বন্ধনের উদাহরণ। দীপনের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পারুল বেগমের জীবনে আলো ফিরিয়ে এনেছিল, আর সেই আলোয় তাদের জীবন ভরে উঠেছিল নতুন আশা এবং ভালোবাসায়। দীপনের এই আত্মত্যাগ generations প্রজন্ম ধরে মা-ছেলের ভালোবাসার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.